কওমী মাদ্রাসা ও প্রযুক্তি

এক.

এক সময় সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে চিঠি আসতে প্রায় এক মাস সময় লাগত। রেজিস্ট্রি করে পাঠালে লাগত বিশ দিনের মতো। অপেক্ষা করতে করতে কখনো প্রিয় মুহূর্তটাই পার হয়ে যেত। সময় বদলেছে। প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে ই-মেইল বা ইলেক্ট্রনিক চিঠি। ‘সেন্ড’ বোতামে টিপ দেয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই চিঠি র্পৌছে যায় আরবে, আমেরিকায় বা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে।

এক সময় কেনাকাটার জন্য লম্বা সময় নষ্ট করতে হত। পণ্য বাছাই, মূল্য পরিশোধ, রিসিপ্ট সংগ্রহ ইত্যাদির জন্য দীর্ঘ লাইনও ধরতে হত কখনো। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন ই-কমার্স বা ইলেক্ট্রনিক বাণিজ্য আমাদের হাতে মুঠোয়। ঘরে বসে আরাম করে পণ্য বাছাই করা, মূল্য পরিশোধ করা, রিসিপ্ট সংগ্রহ করা ইত্যাদি সবই সম্ভব হচ্ছে মাউসের কয়েকটি ক্লিকেই।

প্রযুক্তি এভাবেই আমাদের অনেক কাজ সহজ করে দেয়। বাঁচিয়ে দেয় অনেক মূল্যবান সময়। নি:সন্দেহে এটা আল্লাহ তা’আলার একটি বড় নেয়ামত। যা তিনি আমাদের অধীন করে দিয়েছেন, যেন আমরা তা ব্যবহার করে তাঁর অস্তিত্বকে আরো ভালো ভাবে উপলব্ধি করতে পারি। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَسَخَّرَ لَكُم مَّا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا مِّنْهُ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ ﴿الجاثية: ١٣﴾

এবং তিনি তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদের আয়ত্ত্বাধীন করে দিয়েছেন যা আছে নভোমন্ডলে ও যা আছে ভূমন্ডলে। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। (সূরা জাসিয়া : ১৩)

নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা, তা স্মরণ করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা ওয়াজীব। আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ اذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ هَلْ مِنْ خَالِقٍ غَيْرُ اللَّهِ يَرْزُقُكُم مِّنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ فَأَنَّىٰ تُؤْفَكُونَ ﴿فاطر: ٣﴾

হে মানুষ, তোমাদের প্রতি আল্লাহর নিয়ামত স্মরণ কর। আল্লাহ ব্যতীত এমন কোন স্রষ্টা আছে কি, যে তোমাদেরকে আসমান ও যমীন থেকে রিযিক দান করে? তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতএব তোমরা কোথায় ফিরে যাচ্ছ? (সূরা ফাতির : ৩)

কোনো জাতি আল্লাহর নিয়ামতকে অবহেলা করলে, তা ব্যবহার না করলে বা তার শুকরিয়া আদায় না করলে আল্লাহ তাআলা সে জাতি থেকে তার নিয়ামত উঠিয়ে নেন। তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হন। তিনি বলেন,

ذَٰلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ لَمْ يَكُ مُغَيِّرًا نِّعْمَةً أَنْعَمَهَا عَلَىٰ قَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ وَأَنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ﴿الأنفال: ٥٣﴾

তার কারণ এই যে, আল্লাহ কখনও পরিবর্তন করেন না, সে সব নেয়ামত, যা তিনি কোন জাতিকে দান করেছিলেন, যতক্ষণ না সে জাতি নিজেই পরিবর্তিত করে দেয় নিজের জন্য নির্ধারিত বিষয়। বস্তুতঃ আল্লাহ শ্রবণকারী, মহাজ্ঞানী।

দুই.

প্রযুক্তির সর্বাধুনিক আবিষ্কার ইন্টারনেট। পৃথিবীর কোটি কোটি কম্পিউটারকে একটি কমন নেটওয়ার্কের অধীনে নিয়ে আসে যে প্রযুক্তি, তারই নাম ইন্টারনেট। তারযুক্ত বা তারবিহীন তরঙ্গের ওপর ভেসে আমাদের তথ্য-উপাথ্য বিশ্বের আনাচে কানাচে পৌঁছে দেয় এই প্রযুক্তি। মার্কিন মিলিটারীদের জন্য বিশেষভাবে চালু হওয়া এই প্রযুক্তি আজ পৃথিবীর সব মানুষের জন্য উন্মুক্ত। একটু অন্য ভাষায় ইন্টারনেট প্রযুক্তিকে আমরা বিশ্বের সর্বাধুনিক ও সবচেয়ে শক্তিশালী মিডিয়া বলেও অভিহিত করতে পারি। বরং, এই পরিচয়ই যথোপযুক্ত পরিচয় হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

টেক্সট, অডিও, ভিডিও ইত্যাদি সবই আদান-প্রদান করা সম্ভব এর মাধ্যমে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সবচেয়ে বড় যে সুবিধা আমরা পাই তা হলো মিথস্ক্রিয়া। প্রেরক ও পাঠকের মাঝে প্রতিক্রিয়ার তাৎক্ষণিক আদান-প্রদান। প্রিন্ট মিডিয়া বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে বার্তাটা একপক্ষীয় হয়। একপক্ষ বার্তা প্রদান করে যায়, আর আরেক পক্ষ কেবল তা গ্রহণ করে। প্রতিক্রিয়া জানানোর কোনো ব্যবস্থা থাকে না সেখানে।

কিন্তু ইন্টারনেট মিডিয়া এদিক দিয়ে ভিন্ন। যে কোনো বার্তায় তাৎক্ষণিক মন্তব্য-প্রতিক্রিয়া জানানোর সুবিধা দর্শক-শ্রোতা বা পাঠকের থাকে। ফলে অন্য সব মিডিয়ার তুলনায় অনেক বেশি ইন্টারেক্টিভ ও প্রাণবন্ত ইন্টারনেট মিডিয়া।

পুরো বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দেয়ার এই প্রযুক্তিকে আমরা কাজে লাগাতে পারি ইসলামের দাওয়াতেও। আমাদের প্রবন্ধ-নিবন্ধ, বই, জুমার বয়ান, ওয়াজ মাহফিল সবকিছুই রাখা যেতে পারে এখানে। এবং খুব সহজে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী কোটি কোটি মুসলমানের কাছে পৌঁছে দেয়া যেতে পারে এসব।

ইন্টারনেট মিডিয়ার একটি বড় সুবিধা হলো, অন্যসব মিডিয়ার ন্যায় এখানে কোনো তথ্য কখনো পঁচে না। সার্চ ইঞ্জিনগুলোর কল্যাণে অনেক পুরনো তথ্যও ফিরে পায় সজীবতা। আবার সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। হয় সমালোচনাও।

প্রযুক্তি জীবনকে খুব সহজ করে তোলে। যেসব কাজ আমরা দৈনন্দিন করি, প্রযুক্তি সেগুলোই করে দেয়, তবে অল্প সময়ে, নিখুঁতভাবে। এতে সময় বাঁচে, বরকতও বাড়ে।

স্কুল-কলেজ ও ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা তাদের এ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে প্রযুক্তির স্মরণাপন্ন হয়। ফলে তাদের অনেক সময় বেঁচে যায়। এ্যাসাইনমেন্টে উঠে আসে অনেক নতুন তথ্য। যা শুধু তাদের অতিরিক্ত নম্বর পেতেই সাহায্য করে না, বরং জ্ঞানের বিশাল ভান্ডারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় তাদের।

ইন্টারনেট প্রযুক্তির কল্যানে বিশ্বের বড় বড় পাঠাগার এখন মাউসের ক্লিকেই এ্যাক্সেস করা যায়। বাংলা, আরবি, ইংরেজি, উর্দু সব ভাষায়াই পর্যাপ্ত জ্ঞানের উপকরণ আছে ইন্টারনেটে।

তিন.

ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক, কওমী মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দ বরাবরই প্রযুক্তি থেকে দূরে থাকেন। অথচ প্রযুক্তি ব্যবহার করলে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায়। এমনকি কওমী মাদ্রাসায় পড়ার যে মূল উদ্দেশ্য, দ্বীনের খিদমত করা, সেটাও অনেক বড় পরিসরে খুব সহজে করা সম্ভব।

এছাড়া গবেষণা-মুতালাআ এবং আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্জনেও ভূমিকা রাখতে পারে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট। বক্ষমান প্রবন্ধে আমরা কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের কয়েকটি সুব্যবহার তুলে ধরার চেষ্টা করব।

১. গবেষণা বা মুতালা’আ :

প্রযুক্তির কল্যাণে গবেষণা করা এখন খুব সহজ। বড় বড় লাইব্রেরীর অসংখ্য কিতাব থেকে প্রয়োজনীয় কিতাবটি বের করে কাঙ্ক্ষিত লাইন বের করা এখন মুহূর্তের ব্যাপার।
উদাহরণস্বরূপ, মাকতাবা শামেলা এখন অনেকেই ব্যবহার করছেন। এটি একটি কিতাবের সফটওয়্যার। যাতে হাজার হাজার নির্ভরযোগ্য কিতাব রয়েছে। যে কোনো গবেষণার জন্য খুব সহজেই এটা থেকে কাঙ্ক্ষিত হাদীস, আয়াত, তাফসীর, ব্যাখ্যা, রিজাল, সীরাত বা তারীখ বের করা সম্ভব। এতে রয়েছে উন্নত মানের খোঁজার সুবিধা। যার মাধ্যমে শত শত হাদীসের গ্রন্থ থেকে বা তাফসীরের শত শত কিতাব থেকে অল্প সময়েই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল বের করা যায়। দেশজুড়ে অনেক লেখক, শিক্ষক ও ছাত্র এখন এটি ব্যবহার করছেন, এবং উপকৃত হচ্ছেন বলে জানাচ্ছেন।

অনুরূপভাবে ইন্টারনেটে dorar.net নামে একটি সাইট আছে। যাতে যে কোনো হাদীসের দুয়েকটি শব্দ লিখে দিলে তার নস ও তাখরীজ বের করে দিবে। Alftwa.com এ যে কোনো প্রশ্ন লিখে দিলে তাৎক্ষণিক এর জবাব মিলবে। ahlalhdeeth.com, sunniforum.com ইত্যাদি সাইটগুলো থেকে অনেক ইলমী আলোচনা পাওয়া যাবে। mmf-4.com এ গেলে অনেক দুর্লভ কিতাব, যেগুলো এখনো ছাপা হয় নি, সেসবের পান্ডুলিপি পাওয়া যাবে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্লগ, ফোরাম রয়েছে, বিভিন্ন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক রয়েছেন, যাদের কাছে যে কোনো কিতাব চাইলে তারা সংগ্রহ করে দেয়ার ব্যবস্থা করেন।

এভাবে গবেষণার কাজে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট প্রযুক্তি আমাদের জন্য অনেক বড় নিয়ামত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২. দাওয়াহ ও ইসলামী কার্যক্রম :

ইন্টারনেটের মাধ্যমে অত্যন্ত কার্যকরীভাবে দাওয়াহ কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হওয়া যায়। ইন্টারনেট এমন এক প্রযুক্তি যা দূরত্ব, ট্রাফিক জ্যাম ইত্যাদি সব ধরনের বাধা দূর করে মাদউ (যাকে দাওয়াত দেয়া হয়) কে দায়ীর (যিনি দাওয়াত দেন) কাছে টেনে আনে। ফলে অত্যন্ত সুস্থির পরিবেশে তাকে ইসলামের শান্তির পথে আহ্বান করা যায়।

বর্তমান বিশ্বে আমেরিকা, কানাডা, সাউথ আফ্রিকা, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান ইত্যাদি বিভিন্ন দেশের শত শত কওমী মাদ্রাসার ওয়েবসাইট আছে। এসব ওয়েবসাইটে তারা মাদ্রাসার পরিচিত, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, সিলেবাস, পরীক্ষার ফলাফল, প্রকাশনা ইত্যাদি রাখেন। অনেকে শিক্ষকদের ওয়াজ, বক্তব্য ইত্যাদিও সাইটে রেখে দেন। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ এগুলো পড়তে পারেন, উপকৃত হতে পারেন।

অনেক মাদ্রাসার সাইটে আবার প্রশ্নোত্তরের অপশন থাকে। তাতে মানুষ প্রশ্ন করলে অল্প দিনের মধ্যেই নির্ভরযোগ্য সূত্রসহ উত্তর প্রদান করা হয়। darulifta-deoband.org এবং askimam.org এসব সাইটের মধ্যে অন্যতম।

কিছু কিছু সাইট অনলাইনে পড়াশোনার সুবিধা দিয়ে থাকে। তাতে হাজার মাইল দূরে বসেও কওমী মাদ্রাসার সিলেবাসে পড়াশোনা করার সুযোগ পান একজন ভিজিটর। সম্প্রতি বাংলা ভাষায় এ রকম একটি সাইট চালু হয়েছে। www.qoumi.com । এছাড়া আরো কয়েকটি অনলাইন কওমী মাদ্রাসা সাইট আছে ইংরেজিতে। sunnipath.com এবং darululum.org উল্লেখযোগ্য।

আরবের অনেক আলেমের নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে। তে এর লম্বা তালিকা পাওয়া যাবে। এতে তারা নিজেদের প্রবন্ধ-নিবন্ধ, বই-পুস্তক, অডিও বয়ান, ফতওয়া ইত্যাদি দিয়ে থাকেন। পাঠক এসব সাইট থেকে সরাসরি তাদেরকে প্রশ্ন করতে পারেন, যোগাযোগ করতে পারেন।

এছাড়া আরবি, ইংরেজি মিলিয়ে ইন্টারনেটে কয়েক শত ব্লগ, ফোরাম ও সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট রয়েছে, যেখানে যে কোনো বিষয়ে ইসলামী আলোচনা করা যায়। সব ব্লগে বা ফোরামেই কিছু আলেম থাকেন, যারা সঠিক তথ্য তুলে ধরতে সাহায্য করেন। আলহামদুলিল্লাহ বাংলা ভাষায়ও এখন কয়েকটি ইসলামী ব্লগ ও ফোরাম রয়েছে যেখানে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখালিখি করা যায়, আলোচনা করা যায়। তন্মধ্যে islam.com.bd, idbangla.compeaceinislam.com অন্যতম।

আমাদের দেশের কওমী মাদ্রাসাগুলো এভাবে নিজেদের জন্য ওয়েবসাইট বানিয়ে তাতে নিজেদের যাবতীয় তথ্যাদি রেখে জনগণের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছাতে পারেন। এতে মাদ্রাসা সম্পর্কে জনগণের ভুল ধারণা কমবে। ভুল ধারণা করার অন্যতম কারণ পর্যাপ্ত তথ্য হাতের কাছে না পাওয়া। কাজেই সে অভাব মিটে গেলে ভুল ধারণা অনেকাংশে কমে যাবে। এছাড়া মাদ্রাসার ফলাফল, প্রশ্নোত্তর, ছাত্রদের প্রবন্ধ-নিবন্ধ, শিক্ষকদের প্রবন্ধ-নিবন্ধ, ওয়াজ মাহফিলের বয়ান, অনলাইনে পড়াশোনা –ইত্যাদি সব যদি সাইটে দেয়া যেত, তাহলে তা নি:সন্দেহে অনেক বড় দাওয়াহর কাজ হত।

অনুরূপভাবে যারা লেখক, খতিব বা বক্তা, তারা যদি নিজেদের নামে পৃথক সাইট করে নিজেদের প্রবন্ধ-নিবন্ধ, ডায়েরি, বই-পুস্তক অনলাইনে দিয়ে দিতেন, তাহলে অনেক মুসলিম উপকৃত হতেন।

ইলেক্ট্রনিক দাওয়াহর এ আহ্বান শুনে অনেকেই বলেন, ইন্টারনেট কজনের বাসায় আছে বা কজন বাংলাদেশিই বা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। বাংলাদেশে অবস্থানকারী এবং প্রবাসী বাংলাদেশী অনেকেই এখন নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। আর এ কথা তো সবারই জানা যে, ইন্টারনেট এখন মোবাইল থেকেও ব্যবহার করা যায়। কাজেই ইন্টারনেট ব্যবহারকারী খুব দ্রুত বাড়ছে। কজন পড়বে বলে থেমে থাকার সময় নেই।

৩. আর্থিক স্বচ্ছলতা :

গবেষণা ও দাওয়াহর কাজ ছাড়াও কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে একজন ছাত্র সহজেই স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে। একই সাথে এ কাজ সম্মানজনক, সহজ এবং আর্থিকভাবে সুবিধাজনক।

ইউরোপ-আমেরিকার অনেক কাজ আমাদের দেশের কম্পিউটার জানা ভাই-বোনের ইন্টারনেটের মাধ্যমে করে দেন। এটাকে আউটসোর্সিং বলা হয়। এভাবে তারা ঘরে বসে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেন। ওয়েব ডিজাইন, সফটওয়্যার নির্মাণ, গ্রাফিক্স, টাইপিং, ডাটা এন্ট্রি ইত্যাদি হরেক রকম কাজ ইন্টারনেট ব্যবহার করে করা যায়।

কিন্তু আফসোস হলো, এরকম অনেক সহজ কিন্তু মূল্যবান কাজ মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশ থেকে পাওয়া যায়। সেগুলো শুধু মিশরীরা করে দেয়। আমাদের দেশের কওমী মাদ্রাসার ছাত্ররা যেহেতু আরবী ভালো জানেন, তারা একটু পরিশ্রম করলে সহজেই আরবের এসব কাজ ঘরে বসে করতে পারেন। ফলে একই সাথে ব্যক্তিগতভাবে স্বচ্ছল হবেন এবং দেশকে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সহায়ক হবেন।

চার.

মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের ন্যায় সবকিছুরই ভালো-মন্দ দুই দিক থাকে। প্রযুক্তিও এর বাইরে নয়। তবে মন্দ দিকের ভয়ে এর ব্যবহার পরিত্যাগ করা কাপুরুষতা বৈ কী।

ইন্টারনেটে বাজে উপকরণের সয়লাব, ইমান দুর্বলকারী উপকরণ বেশি ইত্যাদি কারণে অনেকেই ইন্টারনেট ব্যবহার করতে চান না। তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, ইন্টারনেট একটা আলাদা পৃথিবী। বাস্তব পৃথিবীতেও যেমন বাজে জিনিসের সয়লাব, প্রয়োজন হয় সংযমের, তেমনি সে পৃথিবীতেও প্রয়োজন সংযমের।

ছাত্রদেরকে ভালো সাইট ব্যবহার করতে না শেখালে তো সে খারাপ সাইট ব্যবহার করবেই। তাই তার ব্যবহারটা যেন ভালো জিনিস দিয়েই শুরু হয়, তার প্রচেষ্টা করতে হবে। প্রযুক্তি হলো স্রোত, স্রোতকে বাধা দেয়া সম্ভব নয়। ইন্টারনেটের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়বেই, তবে এর সুব্যবহার বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এখন থেকেই নিতে হবে।

বাস্তব পৃথিবীতে যেমন খারাপ জিনিস থেকে ছাত্রদের দূরে রাখতে আমরা দুই ধরনের পথ অবলম্বন করি, এক : নসীহত, দুই : নিয়ন্ত্রণ বা শাসন, তেমনি ইন্টারনেট জগতে খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখতে আমরা তাদের নসীহত করতে পারি। আমরা তাদের ইন্টারনেট ব্যবহারকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। বর্তমানে এমন অনেক সফটওয়্যার আছে, যেগুলো সব ধরনের বাজে সাইটের ব্যবহারে বাধা দিবে এবং কে কখন কোন সাইট ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে, তা জানিয়ে দিবে।

এসব সফটওয়্যার ব্যবহার করে আমরা মাদ্রাসায় ছাত্রদের ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দিতে পারি। সাপের ভয়ে তো তাদের ঘরের ভেতর বন্দী করে রাখতে পারি না। বরং সাপকে ডিঙ্গিয়ে কীভাবে বের হওয়া যাবে, কীভাবে জ্ঞান আহরণ করা যাবে ইন্টারনেটের বিশাল জগত থেকে, সে শিক্ষা, সে আদর্শই আমরা আমাদের ছাত্রদের দিতে পারি।

সারকথা, প্রযুক্তি আমাদের জন্য অনেক বড় নিয়ামত। এ নিয়ামত থেকে দূরে থাকা আল্লাহর অভিশাপের কারণ হতে পারে। তাই নিয়ামতকে আপন করে, সুন্দর ও সুশৃঙ্খল ভাবে ব্যবহার করাই হবে উত্তম আদর্শ।

——————-
লেখাটি ‘আল-ইরশাদ’ পত্রিকার সেপ্টেম্বর ‘১০ সংখ্যায় প্রকাশিত।