পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার ব্যর্থতা ও ড. ইউনুসের বক্তব্য

“ড. ইউনূস বলেন, ২০১৫ সালে পৃথিবীর মোট সম্পদের ৮৫ ভাগ ছিল ৮০ জন ধনী লোকের হাতে। অক্সফামের এক পূর্বাভাসে দেখা গেছে-২০১৬ পৃথিবীর ৯৯ ভাগ সম্পদ চলে যাবে এক ভাগ লোকের কাছে। আর বাকি এক ভাগ সম্পদ থাকবে ৯৯ ভাগ লোকের জন্য। সম্পদের এই বৈষম্য এবং কিছু লোকের হাতেই সব সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে যাওয়া আজকের অর্থনীতির মূল সংকট।”

“সম্পদের বৈষম্য দূর করার দুটি উপায় উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, একটি হলো-অর্থনীতি ব্যবস্থা বদলাতে হবে। আরেকটি হলো শিক্ষা ব্যবস্থা বদলাতে হবে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এমন হতে হবে যেন, সেটা গরিবের জন্য কাজ করে। দরকার হলে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে ব্যাংকিং করার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পর গ্রামীণ ব্যাংক গঠনের কথা স্মরণ করে ড. ইউনূস বলেন, ওই সময় কোনো ব্যাংক গরিবদের টাকা দিতে চাচ্ছিল না। যার কাছে গেছে সেই গরিবদের টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। গ্রামীণ ব্যাংক সেটা সম্ভব করেছে। তিনি বলেন, ‘বৈষম্য কমাতে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা আমূল পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের যে শিক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে সেটা মানুষকে চাকরির দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে।’”

নিউজ লিংক: http://goo.gl/yP4Kxd

===

ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম মৌলিক দর্শনই হলো, সম্পদ যেন মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত না হয়ে যায়।

كَيْ لَا يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنكُمْ

“..যেন সম্পদ কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়।” (আল-কুরআন, ৫৯:৬)

এবং সম্পদের এ অসম বণ্টন প্রতিরোধের জন্যই ইসলামী অর্থব্যবস্থাটা খুব বেশি অংশীদারিত্বের। সম্পদে অংশীদারিত্বের জন্য মুদারাবা-মুশারাকার মতো ঝুঁকি ও লাভে অংশীদারিত্বের কারবার ইসলাম প্রমোট করে। খোদ প্রিয় রাসূল স. তাঁর বিবাহের আগ থেকেই মুদারাবা কারবার সফলতার সাথে করে এসেছেন।

অন্যদিকে, ঝুঁকির অংশগ্রহণ ছাড়া কেবল টাকা থেকে টাকা বানানোর পদ্ধতি – ‘রিবা’ বা সুদকে – ইসলাম হারাম ঘোষণা করে। রিবা ও সম্পদের সুষম বণ্টন কখনো একসঙ্গে হতে পারে না। আর রিবা নিষিদ্ধের মাধ্যমে ইসলাম ঋণ প্রদানকে ব্যবসায় পরিণত করতে বাধা দেয়।

ইসলামে ঋণ একটি সহানুভূতিশীল কাজ, যেখানে দুনিয়াবি কোনো স্বার্থ ঋণদাতার থাকবে না, ফলে ঋণ গ্রহীতার দুরবস্থা নিয়ে ব্যবসা করার অসৎ সুযোগ ঋণদাতার থাকবে না। ইসলামে ঋণ গ্রহণ একটি প্রয়োজনের ফলাফল। প্রয়োজনভিন্ন অন্য যে কোনো কারণে অর্থ গ্রহণ ইসলামে বিনিয়োগ গ্রহণ, যার ঝুঁকি ও লাভের অংশ দাতা ও গ্রহীতাকে পূর্ব নির্ধারিত অংশ অনুপাতে বহন ও গ্রহণ করতে হবে।

বর্তমান বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার কুফল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস সাহেব এ অর্থব্যবস্থা পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি শিক্ষা ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা বলেছেন। কিন্তু পরিবর্তনের ধরণ নিয়ে তিনি তেমন কিছু বলেন নি।

শিক্ষা ব্যবস্থায় যদি নিরঙ্কুশ পুঁজিবাদের উপস্থিতি থাকে, ভালো বেতন আর চাকুরে হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জীবনের গন্তব্য হয়, গরীবের প্রতি যদি করুণার দৃষ্টিতে তাকানোর অভ্যাস তৈরি হয়, তাহলে এতে গরীবের সাথে বৈষম্য দূরীকরণের কোনো সমাধান থাকে না।

ইসলাম মানুষ হিসেবে ধনী-গরীবকে এক করে দেখে। নামাযের কাতারে ধনী-গরীবের পাশাপাশি দাঁড়ানোর প্রধানতম উদ্দেশ্য এটি। আর সম্পদের ক্ষেত্রে ধনীর সম্পদে গরীবের নির্দিষ্ট অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে।

وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِّلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ

“..এবং তাদের (ধনীদের) ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক রয়েছে।” (আল-কুরআন, ৫১:৫৯)

এ হক প্রতিষ্ঠিত, এটা করুণা নয়। ধনী তার সম্পদের ২.৫% যাকাত দিয়ে ফরয দায় থেকে মুক্ত হয়। এর ওপর অতিরিক্ত সওয়াব অর্জনের জন্য সাদাকাহ ও ওয়াকফ করে। সাদাকাহ হলো অতিরিক্ত দান। আর ওয়াকফ হলো দ্বীন, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি জনগণের সুবিধার জন্য কোনো কিছু দান করা, যা সরাসরি ব্যয় না করে তার আয় বা লভ্যাংশ ব্যয় করা হবে। অর্থাৎ মূল দান অক্ষত রাখা হবে, যেন এর সুফল দীর্ঘদিন বয়ে চলে।

ইসলামের শিক্ষা ও ব্যবস্থা ছাড়া বিশ্বমন্দা থেকে উত্তরণের দ্বিতীয় কোনো উপায় নেই। অনেকেই এখন ইসলামী অর্থনৈতিক নীতিমালাকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন, গবেষণা করছেন। যদিও শিরোনামে তারা ‘ইসলাম’ ব্যবহার করেন না।

ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের কথা তুলে ধরেছেন। তবে দু:খজনক হলেও সত্য যে, তা গরীবকে স্বচ্ছল করার পরিবর্তে তাকে আরো গরীবে পরিণত করেছে, আর ধনীকে আরো ধনী।

আমরা আশা করব ড. ইউনূস সাহেব বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনে সুস্পষ্ট সত্যটি উচ্চারণ করবেন; ইসলামী অর্থনীতির কথা বলবেন।