লাবীব ভাই ফোনটা করেছিলেন ঈদের পরপর। ময়মনসিংহে একটা ইসলামিক বই মেলা হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কিছু কথা বলতে হবে। লাবীব ভাইয়ের অনুরোধে ‘না’ বলার স্পর্ধা এখনো হয় নি। তাই ‘হ্যাঁ’ -ই বলেছিলাম সেদিন।
লাবীব ভাই জানিয়েছিলেন, বইমেলার এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে আরো যাচ্ছেন আমার প্রাণপ্রিয় শিক্ষক, বিশিষ্ট ইসলামী শিশুসাহিত্যিক মাওলানা নাসীম আরাফাত সাহেব, বিশিষ্ট ইসলামী সাহিত্যিক মাওলানা যাইনুল আবেদীন সহ আরো অনেকে।
এই যে ‘লাবীব ভাই’ বলছি,তাঁর পরিচয়টা একটু দিয়ে নিই। নতুবা পাঠক ভাববেন, তিনি আমার সমবয়সী বা অল্প বয়সের পার্থক্যের কোনো যেনতেন ভাই। না। তিনি মাওলানা লাবীব আব্দুল্লাহ। শিকড় সাহিত্য মাহফিলের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। মুহাদ্দিস। মুদাররিস। মানুষ বানানোর কারিগর। বয়সে আমাদের চেয়ে প্রায় দশ-বারো বছরের সিনিয়র। কিন্তু.. কথাবার্তায়, আচার-আচরণে চির তরুণ তিনি। এজন্যই আমার কাছে তিনি ‘মাওলানা লাবীব সাহেব’ নন, বরং ‘লাবীব ভাই’।
শুধু আমার কাছে নয়, যারা ইসলাম কিছু লেখালিখি করছেন, সবার কাছেই তিনি প্রিয় ‘লাবীব ভাই’। জহীর উদ্দীন বাবর, মুফতি এনায়েত, মাসউদুল কাদির, রোকন রাইয়্যান এমনকি আমার প্রিয় শিক্ষক মাওলানা নাসীম আরাফাত সাহেবের কাছেও তিনি ‘লাবীব ভাই’।
গত বছর তিনেক আগে এভাবেই ময়মনসিংহের বড় মসজিদের কাছে একটি বইমেলা আয়োজন করেন তিনি। তিন বছর পর এখন তা নিয়মিত একটি বইমেলা। এভাবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সৃজনশীল এবং গঠনমূলক ইসলামী কাজে তার জুড়ি নেই।
যাহোক, লাবীব ভাইয়ের দাওয়াতে এটা বলা ছিল যে, জায়গাটি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায়। কিন্তু বাস্তবে জায়গাটি কেমন, তা বোধকরি মেহমানদের কেউই আগে বুঝতে পারেন নি। সবার মতো আমিও ভেবেছিলাম, বিশাল কোনো বই মেলা, হাজার হাজার মানুষ হবে ইত্যাদি।
তো, আমরা ঢাকা থেকে রওয়ানা হলাম সকাল দশটায়। ফুলবাড়িয়ায় পৌঁছাতে প্রায় দুপুর দেড়টা বেজে গেল। নামায পড়ে নিলাম। এরপর খাওয়া দাওয়ার সেরে চলে গেলাম বই মেলা প্রাঙ্গনে।
অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা দুপুর তিনটায়। ঘড়িতে সাড়ে তিনটা বেজে গেছে। একী, প্যান্ডেলের নিচে শুধু আমরা আলোচকরাই। সব চেয়ার ফাঁকা। ছয়টি স্টলের আশে পাশেও তেমন কেউ নেই। তখনো অনেকের কাছে ‘মেলা’টা কৌতুক মনে হচ্ছিল।
লাবীব ভাই মাইক হাতে নিলেন। অনুষ্ঠান শুরু করার ঘোষণা দিলেন। কুরআন তেলাওয়াত হলো। বিশেষ আলোচকগণ মঞ্চে গিয়ে বসলেন। পেছনে তখনো ফাঁকা। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। একজন কি দুজন আলোচনা করলেন। আসরের নামাযের বিরতি দেয়া হলো।
নামাযের পর কোথা থেকে যে এত মানুষ হলো বুঝতে পারলাম না। জায়গাটি ছিল একটি রাস্তার দু পাশ নিয়ে। এক পাশে বই মেলার পাঁচ-ছয়টি স্টল, আরেক পাশে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্যান্ডেল। প্যান্ডেলের দুই পাশে পুকুর বা ডোবা। প্রথম তো মনে হচ্ছিল এখানে মানুষজন কেউ থাকেই না।
কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে অনেক মানুষ হয়ে গেল। একে একে বক্তব্য রাখলেন পান্থ সাইফ, আলী হাসান, হুমায়ুন আইয়্যুব, আমি, মাওলানা নাসীম আরাফাত ও মাওলানা যাইনুল আবিদীন। মাগরীবের নামাযের সময় হলে নামাযের বিরতি দেয়া হলো। নামাযের পর আমরা যারা ঢাকা থেকে গিয়েছি, তারা ফিরে আসার প্রস্তুতি নিলাম। স্থানীয় ও আশে পাশের বক্তারা বক্তব্য দিতে থাকলেন।
বক্তারা সবাই বইমেলাটিকে ফুলবাড়িয়াবাসীদের জন্য সৌভাগ্যের কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। বর্তমান সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের যুগে যেখানে আমাদের কিশোর-যুবকরা সারাদিন টিভি দেখে তাদের চিন্তা শক্তিকে নষ্ট করে ফেলছে, তখন এরকম বইমেলা তাদেরকে বই পড়তে আগ্রহী করে তুলবে, তাদেরকে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করবে বলে অনেকে মত ব্যক্ত করেন।
মাওলানা নাসীম আরাফাত সাহেব বলেন, আগামী বছর এখানে একটি পাঠাগার দেখতে চাই। দেখতে চাই যে, আগামীতে সেই পাঠাগারের উদ্যোগেই বইমেলা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, অনেকেই মনে করেন, একটা তাফসীর মাহফিল আয়োজনে টাকা দিলেই ইসলামের খিদমত হলো। ওয়াজ মাহফিলে টাকা দিলেই ইসলাম হয়ে গেল। কিন্তু একটি ইসলামী বই ছাপাতে টাকা দেয়া, বা একটি ইসলামী পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করাকে কেউ ইসলাম মনে করে না। এটা খুব দু:খজনক।
মাওলানা যাইনুল আবিদীন বলেন, ওয়াজ মাহফিলে একজন বক্তা কখনো তার বক্তব্য শেষ করতে পারেন না। তার অনেক কিছু বলার থাকে, শ্রোতারও অনেক কিছু শোনার থাকে। কিন্তু তা শেষ হয় না। অতৃপ্ত থেকে যায় বক্তা এবং শ্রোতা। পক্ষান্তরে একটি বই কখনো কখনো বন্ধু ও আত্মীয়তার হাত ধরে দেশে-বিদেশে গিয়ে অনেক মানুষকে পরিতৃপ্ত করে আসে। পরিবর্তন করে আসে পাঠকের মন, চিন্তা-চেতনা।
আমি আমার বক্তব্যে বলি, হাদীসে আছে, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা হলো মুমিনের হারানো সম্পদ। কোথাও পেলে সে-ই এর বেশি হকদার হবে। আজ যে এখানে বই মেলা হচ্ছে, এ যেন আমাদের হারিয়ে যাওয়া সম্পদ। এবং নিজের হারানো সম্পদ কারো হাতে দেখলে মানুষ যেভাবে তা কেড়ে নিতে উদ্যত হয়, সেভাবে আজ এ জ্ঞানের মেলা থেকে জ্ঞানের উপাদান বই আমাদেরকে সর্বাগ্রে হাতে তুলে নিতে হবে। উপহার দিতে হবে বন্ধু বান্ধব ও আত্মীয় স্বজনকে।
শিক্ষক মাওলানা নাসীম আরাফাত সাহেব আসার সময় বললেন, ইঊসুফ, ভেবে দেখো, কত উঁচু সাহসের অধিকারী হলে এমনটা করা যায়! প্রায় গ্রামে, যেখানে মাহফিলে লোকজন জড়ো করা সম্ভব, কিন্তু বইমেলা!
আমি স্থানীয় কয়েকজনের সাথে কথা বললাম। বয়স ১৯-২৪ হবে। সবাই ব্যবসা করে। তারা খুব খুশি। এমন জায়গায় একটা বই মেলা পেয়ে। অনেকেই বই উল্টে এদিক সেদিক দেখছে। কেউ কিনে নিচ্ছে।
চায়ের দোকানে একজন বয়স্ক লোককে বলতে শুনলাম, আজ বইমেলা আছে তাই তিনি কোথাও যাচ্ছেন না। ওখানেই বসবেন। লাবীব ভাই ফেরার পথে জানালেন, সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই প্রতিটি স্টলে হাজার টাকার উপরে বই বিক্রি হয়ে গেছে। সবাই খুব খুশি।
সত্যিই অবাক করা ব্যাপার। মফস্বলের একটি খোলা মাঠে বইমেলা করে জমিয়ে ফেলা – কতটুকু কঠিন, তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মাত্রই বুঝতে পারবেন। গত কয়েকদিন আগেও এভাবে লাবীব ভাইরা ময়মনসিংহের এক অমুসলিম গ্রামে (সাবেক মুসলিম) মাহফিলের আয়োজন করেছিলেন। তার বর্ণনা শুনেও আশ্চর্য হতে হয়। দোয়া করি আল্লাহ এই মানুষটিকে সুস্থ রাখুন, ইসলামের আরো খিদমত করার তাওফীক দিন।
আসার পথে শিক্ষক মাওলানা নাসীম আরাফাত সাহেবকে তারা বইগুলো নিয়ে একটি ওয়েবসাইট করার অনুরোধ জানালাম। তিনি মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনলেন এবং খুব উৎসাহের সাথে সম্মতি জ্ঞাপন করলেন। ইনশা’আল্লাহ শীঘ্রই হয়ত তাঁর মূল্যবান বইগুলো ইন্টারনেটের পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া যাবে।
মন্তব্য : পৃথিবীকে বদলে দিতে একজন মাহাতিরের সৎ উদ্যোগই যথেষ্ট।
ইউসুফ ভাই! চমতকার ডায়েরী। ময়মনসিংহের বইমেলায় না গিয়েও বইমেলার স্বাদ উপভোগ করলাম। ধন্যবাদ।
জহির উদ্দিন বাবর ভাইকে ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।
আলহামদুলিল্লাহ্, পড়ে খুব ভালো লাগলো।
Alhamdulillah jene khub valo laglo. Doa chai.