আমার ডায়েরি : ০৭/১০/২০১০ : সালমান খান, খান একাডেমী এবং আমাদের প্রেরণা

বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত সালমান খানের খান একাডেমী গুগলের ‘পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে এমন পাঁচটি আইডিয়ার‘ মধ্যে শিক্ষা বিভাগের পুরস্কার জিতে নিয়েছে। গুগল প্রায় দুই বছর যাচাই বাছাই করে ৫ টি সাইটকে পৃথিবীকে বদলে দেয়ার হাতিয়ার হিসেবে নির্বাচন করেছে। এর মধ্যে শিক্ষা বিভাগে জায়গা করে নিয়েছে খান একাডেমী। জিতেছে কয়েক কোটি টাকা।

বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার (লিংক : ১ | লিংক : ২) দুই তিন দিন আগে চ্যাটিংয়ের সময় ছোট ভাই খান একাডেমীর লিংক দিয়েছিল। সাইটটার নাম কোথাও শুনেছি মনে হচ্ছিল। কিন্তু ভেবে পাচ্ছিলাম না কোথায় শুনেছি। পরে একদিন পর মনে পড়ল, আরো দুই তিন দিন আগে বাসে বসে গুগলের অফিসিয়াল ব্লগ পড়তে গিয়ে খান একাডেমী সম্পর্কে জেনেছিলাম।

যাই হোক, লিংক পেয়ে খান একাডেমীতে ঢুঁ মারলাম। বুঝলাম, সাইন্স ও ম্যাথমেটিক্সের ছাত্রদের জন্য সাইটটি বেশ উপকারী। সালমান সাহেব দীর্ঘ সাত বছরে সাইন্স ও ম্যাথমেটিক্সের নানা বিষয় নিয়ে সতের শ’র বেশি ভিডিও সাইটটিতে রেখেছেন। প্রায় দশ মিনিট ব্যাপী প্রতিটি ভিডিওতে তিনি খুব সহজে অনেক কঠিন কঠিন বিষয় তুলে ধরেছেন। ফলে শিক্ষার্থীদের কাছে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন।

তার সম্পর্কে পড়তে গিয়ে জানতে পারি, এক কাজিনকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে পড়াতে গিয়ে তাকে প্রথম এ ধরনের ভিডিও করতে হয়েছিল। পরে অন্য অনেকে এসব ভিডিও চাইলে তিনি একটি সাইট বানিয়ে তাতে সেসব রাখতে শুরু করেন। এ ক্ষেত্রে ভিডিও আপলোডের জন্য তিনি ইউটিউবকে ব্যবহার করেন।

তার ভিডিওগুলো অত্যন্ত সহজ হওয়ায় অল্প দিনেই তিনি বিশ্বব্যাপী কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের মন জয় করতে সক্ষম হন। এক টিভি সাক্ষাৎকারে বিল গেটস নিজেকে খান একাডেমীর ভক্ত রূপে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। তিনি বলেন, এখন তার এগারো বছরের শিশুকে নিয়ে তিনি খান একাডেমীতে নিয়মিত এ্যলজেব্রা, বায়োলজী ইত্যাদি শিখছেন।

এ কথা বলতে আমিও গর্ববোধ করছি যে, খান একাডেমীর একজন ভক্ত আমিও। ব্যাংকিং ও ফিন্যানসিয়াল বিভিন্ন বিষয়ে ধারণা নিচ্ছি খান একাডেমী থেকে।

গত মাস কয়েক আগে বিল গেটসের এক লেকচার পড়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, আগামী কয়েক বছর পর পৃথিবীতে কলেজ-ইউনিভার্সিটি শুধু নামেই থাকবে। মানুষ শুধু ফেয়ারওয়েল আর আড্ডাবাজী করতে কলেজ-ভার্সিটিতে যাবে। কারণ পৃথিবীর সেরা সেরা ভার্সিটির লেকচারগুলো সব ইন্টারনেটেই পাওয়া যাবে। তাই সেসব ছেড়ে লোকাল ক্লাসে যাওয়ার আর প্রয়োজন পড়বে না। যার যা জানার ইচ্ছা, ইন্টারনেট থেকেই জেনে নিতে পারবে।

কথাটা আমাকে খুব নাড়া দিয়েছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটেই চিন্তা করুন। একটা ছেলের ইকোনোমিক্স নিয়ে পড়ার স্বপ্ন। কিন্তু পর্যাপ্ত ভার্সিটির অভাবে সে স্বপ্নের সাবজেক্টটি পায় নি। কিংবা সাবজেক্ট পেলেও যোগ্য শিক্ষকের অভাব বা ক্লাসের স্বল্পতা তার স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ইন্টারনেটে ঠিকই সে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির লেকচার নিয়মিত পাচ্ছে। কাজেই সেখানে ক্লাস করে সে তার যোগ্যতা গড়ে নিতে পারবে। তাকে আর হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বিদেশ যেতে হবে না। আবার কাঙ্ক্ষিত বিষয় না পাওয়ায় তার স্বপ্নকেও ভাঙতে হবে না।

হা, বাকি থাকল ডিগ্রী আর টিমওয়ার্কের ব্যাপারটা। তো অনলাইন ইউনিভার্সিটির জনপ্রিয়তা যেমন বাড়ছে, তেমনি এর ডিগ্রীর মূল্যও বেড়ে যাচ্ছে। আর টিমওয়ার্কের জন্য স্টুডেন্সটস ফোরাম তো থাকছেই।

আচ্ছা, অন্য প্রসঙ্গ। ধরুন, একজন মাদ্রাসার ছাত্র। ইসলাম ও আরবী সম্পর্কিত যাবতীয় নিম্ন, মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষা সে গ্রহণ করেছে। এখন সে ম্যানেজমেন্ট, মার্কেটিং ইত্যাদি বিজনেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সাবজেক্টগুলো পড়াশোনা করতে চাচ্ছে। কিংবা আইন ও স্বাস্থ্য নিয়ে পড়তে চাচ্ছে।

গতানুগতিক শিক্ষা পদ্ধতিতে তার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। কেননা ভালো কোনো ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ, এমবিএ করতে হলে তাকে তাদের রিকয়েরমেন্ট অনুযায়ী এসএসসি ও এইচএসসির রেজাল্ট নিয়ে আসতে হবে। বয়স ও সময়ের ব্যাপার তো আছেই। তার ওপর কর্মজীবন তার স্বপ্নকে চেপে মেরে ফেলতে পারে।

কিন্তু নেটভিত্তিক খান একাডেমী বা এ ধরনের অনলাইন ক্লাসগুলো তার স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে আরো অনেক দূর। সে মাদ্রাসার ছাত্র হয়েও হয়ে উঠতে পারে বিজনেস স্পেশালিস্ট, আইটি কনসালটেন্ট, ল’ স্পেশালিস্ট সহ আরো অনেক কিছু। তার শিক্ষার পথে বাধা হবে না আর কিছুই।

একই ভাবে আপনি একজন বিবিএ, ডাক্তার বা অন্য কোনো সাবজেক্টের বিশেষজ্ঞ। ইসলামী বিভিন্ন বিষয়ে যদি এমন সহজ টিউটোরিয়াল আপনি পেয়ে যান, তাহলে আপনিও হয়ে উঠতে পারেন একজন আলেম। আলেম হওয়া শুধু গতানুগতিক শিক্ষা সমাপ্ত করার নাম নয়।

এভাবে শিক্ষার উপাদানগুলো সহজ লভ্য করণের মাধ্যমে আমাদের সবার মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যেতে পারে।

আমি কখনোই বলছি না যে অনলাইন একাডেমীতে কোর্স করে কেউ একাডেমিক কোর্স করা ব্যক্তির সমপর্যায়ের হয়ে যাবে। তা হয়ত হবে না, তবে অন্তত জরুরী বিষয়গুলো সবার জানা থাকবে।

এমন হবে যে একজন লোক আলেম হয়েও ব্যবসা বাণিজ্য করার জন্য তার যা যা প্রয়োজন, সে জানবে। আবার একজন বিবিএ হয়েও মুসলিম হিসেবে তার যা যা জানা দরকার, সহজেই জানবে।

ইসলাম নিয়ে যারা কাজ করছেন, তাদের প্রতি অনুরোধ :

যারা ইসলাম নিয়ে কাজ করছেন তারা খান একাডেমীর এ ধারণা থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারেন। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে ছোট ছোট টিউটোরিয়াল বানিয়ে ইউটিউবে আপলোড করে দিতে পারেন। যেমন ধরুন নামায পড়ার পদ্ধতি কী? এটা দুটো ১০ মিনিটের ভিডিও দিয়ে ব্যাখ্যা করা হবে।

১ম ভিডিও : নামায কেন পড়তে হয়? কখন পড়তে হয়? কোন কোন নামায ফরয, কোনগুলো ওয়াজীব, কোনগুলো মুস্তাহাব ইত্যাদি।
২য় ভিডিও : নামায কী কারণে ভেঙে যায়? সিজদায়ে সাহু কেন দিতে হয়? ইত্যাদি।

তেমন ভাবে যাকাত নিয়ে নিম্নের ভিডিওগুলো হতে পারে।

১. যাকাত কী? কেন দিতে হয়? প্রদানকারীর কী লাভ?
২. যাকাত কীভাবে হিসাব করতে হয়? বছর অতিক্রান্ত হওয়ার অর্থ কী? কোন কোন সম্পদে যাকাত দিতে হয়?
৩. আধুনিক বিভিন্ন সম্পদে যাকাত কীভাবে হিসব করতে হবে? শেয়ার, বন্ড ইত্যাদি।
৪. যাকাত কাকে কাকে দেয়া যাবে?

এভাবে ইসলামের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সহজ ভিডিও টিউটোরিয়ালের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয়া যেতে পারে। টিউটোরিয়ালগুলোতে ছকের মাধ্যমে সহজে সব বুঝিয়ে দেয়া হবে।

এর জন্য কোনো বড় টীমের প্রয়োজন নেই। সালমান খান প্রমাণ করেছেন যে, বিশ্ব পরিবর্তন করার জন্য একজন উৎসর্গিত লোকই যথেষ্ট।

তবে এরপরও কাজের গতি ঠিক রাখার জন্য একটা টিম করা যেতে পারে। যে যেই বিষয়ে পারদর্শী, তিনি সে বিষয়ে টিউটোরিয়াল বানাতে পারেন।

এভাবে ৫-১০ বছর পর ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের উপর হাজার হাজার ভিডিও পাওয়া যাবে। জ্ঞানের পিপাসায় কাউকে আর মরতে হবে না।

চোখ বন্ধ করে একটু ভাবুন তো, তখন কেমন হবে?! …. !!