আমার ডায়েরি ২২/১১/২০১২ : আমাদের লুৎফুর ও মাওলানা লুৎফুর রহমান

সর্বশেষ কবে “আমার ডায়েরি” শিরোনামে পোষ্ট লিখেছি মনে নেই। সম্ভবত দেড় বছরের মতো হবে। যেদিন প্রথম ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় লাইভ অনুষ্ঠানে বসেছি তার দিন দুয়েক আগে-পরে হবে। ভাবিনি পরের ডায়েরিটা এমন একটি বিষয় নিয়ে লিখতে হবে।

গত ৬ই নভেম্বর ২০১২। জামিয়াতুল আস’আদ কুরবানীর বন্ধের পর মাত্র খুলেছে। দরস-তাদরীসের ব্যস্ততা মাঝারি পর্যায়ের। জামিয়ার অন্যতম নবীন উস্তায – মাওলানা লুৎফুর রহমান – কোন এক কাজে বাসায় গেলেন, মালিবাগে। বাসায় মেহমান ছিল। তাদের জন্য সিএনজি আনা প্রয়োজন। মাওলানা ও আরো একজন বের হলেন সিএনজি খুঁজতে। অপরজন ফিরলেন, মাওলানা আর ফিরলেন না। পরে জানা গেল পুলিশ তাকে সন্দেহের ভিত্তিতে ধরে নিয়ে গেছে।

এরপর খিলগাঁও থানা, রামপুরা থানা, রিমান্ড এবং অবশেষে কারাগারে। শুনানির পর শুনানি হচ্ছে কিন্তু জামিন মঞ্জুর হচ্ছে না। মাওলানাকে যে কেস দেওয়া হয়েছে তার বিবরণে আছে যে, সে নাকি পুলিশকে আক্রমণ করতে চেয়েছিল এবং সে সহ অনেকের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষ্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে!

মাওলানা লুৎফুর রহমান বললে একটু দূরের মনে হয়, তাই শিরোনামের মত বলি, আমাদের লুৎফুর। আমাদের এই লুৎফুরের সাথে আমার পরিচয় সেই চতুর্থ কি পঞ্চম জামাতে। হিদায়াতুন্নাহু বা কাফিয়ার বছর। বয়স আমার চেয়ে বছর খানেক কম। তখন দাড়ি ছিল না। আমার মতই। এরপর প্রায় দশ বছরের বেশি সময় ছাত্রজীবন ও কর্মজীবনে একসঙ্গে পথচলা।

আমার সাথে শুরু থেকে খুব সখ্য ছিল তা নয়, তবে ভালো লাগত। ভালো লাগত এজন্য যে, পুরো ক্লাসে আমার কাছাকাছি বয়সের কেবল দুজন ছিল। তাদের একজন আমাদের লুৎফুর। অন্য সবাই বয়সে বড়।

লুৎফুরকে দেখতাম সারাদিন বই পড়ত। পাঠ্য বই, গল্প-উপন্যাস ইত্যাদি নানা রকম বই। এক কথায় বইপোকা। ক্লাসের সময় ক্লাস, অন্য সময় বই। কখনো রাতে সবাই শুয়ে পড়ার পরও দেখতাম পড়ছে। আজব লাগত।

কখনো বসে বসে কবিতা লিখত, গল্প লিখত। লেখালিখির অভ্যাস সে সময় থেকেই। আমাদের মধ্যে কিছু গুছিয়ে লেখার প্রয়োজন হলে বিনা বাক্যে দুজনের নাম উঠে আসত। এক, জাবের আল হুদা ভাই (বর্তমানে সিলেটে এক মাদ্রাসার মুহাদ্দিস ও পরিচালক); দুই, লুৎফুর।

বই পড়া ছাড়া অন্য কোনো নেশা তার ছিল না। রাত বেশি করে পড়ার কারণে মাঝেমধ্যেই প্রচন্ড মাথা-ব্যথা হত। রাজনৈতিক দল বা কোনো সংগঠনের সাথে জড়িত থাকার তো প্রশ্নই আসে না।

দাওরা হাদীস শেষ করার পর আমরা প্রিয় উস্তায মুফতী হাফিজুদ্দীন সাহেবের নেতৃত্বে শুরু করলাম জামিয়াতুল আস’আদ। হুযুরের দৃষ্টিভঙ্গিটা একটু ভিন্ন। শুধু বই পড়া মুফতী নয়, সরাসরি মাঠপর্যায়ে ইসলামের কাজ করতে পারে এমন মুফতী তৈরী করা। সে লক্ষেই জামিয়ার ছাত্ররা প্রতি বছর সেসব এলাকায় গিয়ে দাওয়াতের কাজে অংশগ্রহণ করেন, যেসব এলাকায় মানুষের ঈমান ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। মানুষ মুসলিম হিসেবে জন্ম নিয়েও অমুসলিম হয়ে যাচ্ছে।

প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে মাওলানা লুৎফুর রহমানের অক্লান্ত পরিশ্রম জামিয়ার প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বাক্ষী হয়ে আছে। অনেকে হয়ত জানেন না জামিয়ায় মাওলানার অবদান কতটুকু। বেশি কিছু না বলে শুধু জামিয়ার ওয়েবসাইটের পাঠকপ্রিয়তা উল্লেখ করলেই তা বোঝানো সম্ভব।

মনে আছে যখন আমি বিভিন্ন ব্লগে লিখতাম, জামিয়ার প্রথম বছর, মাওলানা তখন আমাকে ‘ব্লগার’ বলে হাসত। আমি তখন নানাভাবে তাকে প্রতিদিন উদ্বুদ্ধ করতাম। আমার বিশ্বাস ছিল, যখন অনলাইনে মানুষ প্রশ্ন করবে, জানতে চাইবে, তখন মাওলানা তার কলম বন্ধ করে রাখতে পারবে না। জাতি তার কাছে পাবে অনেক কিছু।

বেশ কিছু দিন সময় নিয়ে নিজেই জামিয়ার ওয়েবসাইট তৈরী করলাম। মাওলানাকে পাসওয়ার্ড দেওয়া হলো। ওয়েবসাইটে প্রশ্নও আসতে শুরু করল। মাওলানা উত্তর লিখতে শুরু করল। অল্প দিনেই জামিয়ার ওয়েবসাইট জনপ্রিয় হয়ে উঠল।

প্রতিদিন দশ-বারোটি করে প্রশ্ন আসে। মাওলানা উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যায়। পরদিন ক্লাস করাতে গিয়ে দেখি চোখ লাল। এমন একদিন দুইদিন নয়, প্রায় প্রতিদিন একই গল্প।

মাওলানা যে আজ ষোল দিন ধরে জামিয়ায় নেই, এখনো প্রতিদিন প্রশ্ন আসছে জামিয়ার ই-মেইলে। মনে চায় কারাগারে তাকে একটি ল্যাপটপ দিয়ে আসি। পাঠকের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে শৃঙ্খলের কষ্টটা হয়ত সে ভুলে যেত।

ফেইসুবকের একাধিক পেইজে মাওলানা দীর্ঘদিন মানুষের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেছে। নাম গোপন থাকায় পাঠক কখনো জানতে পারেনি কে উত্তর দিয়েছে। মাওলানাকে বলেছিলাম, নামটা প্রকাশ করলেই কি ভালো নয়? সে উত্তরে বলেছিল, ইসলামের খিদমতের জন্য নামের প্রয়োজন কী? এরপর আমি যা উত্তরে বলেছিলাম, তা টিকেনি।

মাওলানার এই দুর্দিনে আমরা তার সকল সহপাঠি, বন্ধু, সহকর্মী এবং তার সকল ছাত্র-শিক্ষক সমব্যথী এবং সবাই আল্লাহর কাছে দোয়া করছি। শুনেছি কারাগারে সে নামাযের ইমামতি করে। অন্যরা শ্রদ্ধায় তার কাপড় পর্যন্ত ধুয়ে দেয়। একজন আলিমের মর্যাদা এমনই। যেখানেই সে যায়, আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিকে তার ভক্ত বানিয়ে দেন।

শুনেছি, দেশের পরিস্থিতির কারণে সরকারের পক্ষ থেকে জামিন দিতে নিষেধ করা হয়েছে। দেশের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় আমরা তা স্বাগত জানাই। কিন্তু একই সাথে, যারা নির্দোষ, যাদের বিরুদ্ধে দোষ প্রমাণিত হয়নি, তাদের অবিলম্বে মুক্তি কামনা করছি। আমাদের জানা মতে নির্দোষ কাউকে আটক রাখা তার মৌলিক অধিকার পরিপন্থী।

আল্লাহ তায়ালা যতশীঘ্র সম্ভব আমাদের লুৎফুরকে আমাদর কাছে ফিরিয়ে আনুন। আমীন।