প্রসঙ্গ হজ্জ্বের বিরোধিতার অসারতা

কেউ হজ্জ্বের বিরোধিতা করবে, এটা তার ব্যাপার; সে মুসলিম না কাফের – সে আলোচনায় গেলাম না। কিন্তু এর কারণ হিসেবে যা বলা হলো, তা চূড়ান্ত অজ্ঞতা প্রকাশ ছাড়া কিছুই না।

প্রথমত, হজ্জ্ব রাসূল স. -র যুগ থেকে শুরু হয় নি, ইবরাহীম আ. -র যুগ থেকেই নিয়মিত হজ্জ্ব চলছে। জাহেলী যুগেই হজ্জ্বকে কেন্দ্র করে হাজারো মানুষের আয় রোজগার চলত। তৎকালীন যুগে হজ্জ্ব কেবল ইবাদত ছিল না, বরং হজ্জ্ব ছিল পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের অর্থনীতির যোগসূত্র। আগের স্ট্যাটাসে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। [দেখুন: https://yousufsultan.com/economic-impact-of-hajj/]

জাহেলী যুগে হজ্জ্বের মৌসুমে উকায, যুল মাজাযসহ নানা বাজার বা মেলা বসত। প্রচুর ক্রয়-বিক্রয় হত সেখানে। বলতে গেলে সতের শতাব্দীর আগে এ যোগসূত্রে ইউরোপ আসতে পারে নি।

হজ্জ্ব ছিল বিশ্ব-মিডিয়া। কোনো বিষয় পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে হজ্জ্ব ছিল অনন্য। এজন্যই মুশরিকরা হজ্জ্বের মৌসুমে রাসূলের স. বিরুদ্ধে নানা কথা ছড়ানোর চেষ্টা করত, অনেকটা বর্তমানে প্রভাবশালীদের মিডিয়া দখলের ন্যায়। অবশ্য মুসলিমরাও হজ্জ্বের মৌসুমকেই ইসলাম প্রচারের বড় মিডিয়া হিসেবে গ্রহণ করে। মদীনার প্রথম দিকের মুসলিমবৃন্দ হজ্জ্বের সময়ই রাসূলের স. সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাদের আগ্রহ-আপ্যায়নেই রাসূল স. মদীনার প্রতি ভালবাসা অনুভব করেন।

দ্বিতীয়ত, আরবরা ডাকাত ছিল না। নানা রকম অশালীন কর্মকাণ্ড ক্ষেত্রবিশেষে ছিল, তবে ডাকাতি ছিল না। আরবরা পরিশ্রমী ছিল, জন্মগতভাবে ব্যবসায়ী ছিল। রিহলাতাশ শিতা’ ওয়াস সাইফ – গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন দুটো বড় ব্যবসায়িক যাত্রা ছিল তাদের। এটা রাসূলে আরাবী স. আসার পর থেকে নয়, শত শত বছর আগে থেকেই।

তৃতীয়ত, হজ্জ্ব কেন্দ্রিক এ অর্থনীতি শুধু আগে ছিল, বর্তমানে নেই, এমনটা নয়। সাউদীর কথা বাদ দিলাম, আমাদের বাংলাদেশ নিয়ে বলি। শুধু বিমান বাংলাদেশই গত ২০১২ তে হজ্জ্ব ফ্লাইট পরিচালনা করে ৮০ কোটি টাকা লাভ করে, যা সারা বছর লোকসানে থাকা বিমানের জন্য অনেক কিছু। [দেখুন: http://www.thefinancialexpress-bd.com/old/index.php?ref=MjBfMTJfMDlfMTJfMV8xXzE1MjYyOA==] হজ্জ্বকে কেন্দ্র করে লাখো মানুষের কর্মসংস্থান হয়, ব্যবসা হয়।

চতুর্থত, বাংলাদেশের মানুষ সারা বছর বিভিন্ন দেশে গিয়েও অনেক টাকা খরচ করেন। একটি তথ্য মতে শুধু ২০১১ তেই বাংলাদেশের মানুষ অন্য দেশে যাত্রা ও ট্যুরিজমে ব্যয় করেন প্রায় ৬০০০ কোটি টাকা। [দেখুন: http://www.indexmundi.com/facts/bangladesh/international-tourism > International tourism, expenditures] অন্য দেশে ঘুরতে গিয়ে কেউ প্রোডাকশন করে না রিডাকশন করে, সে প্রশ্ন কিন্তু তোলা হয় না। বিভিন্ন দেশের ফেয়ারে যাওয়া হয়, কোটি কোটি টাকা অপচয় করা হয়। সরকারী টাকায় ঘন ঘন অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফরে প্রোডাকশন কীভাবে হয় – তাও অস্পষ্ট। অবশ্য সেগুলো আলোচ্য নয়, হজ্জ্বই আলোচ্য।

অথচ, অন্য দেশে প্রমোদ ভ্রমণে গিয়ে মানুষ অনেক নৈতিক অবক্ষয়কে সঙ্গে করে নিয়ে আসে, বা কমপক্ষে তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক উন্নয়নে তা তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না। পক্ষান্তরে হজ্জ্বকে কেন্দ্র করে সকল ইবাদত ব্যক্তির নৈতিক উন্নয়ন ও মানুষ হিসেবে তাকে পরিশুদ্ধ করণে ভূমিকা রাখে। ফলে সে সমাজের জন্য ভালো কিছু প্রোডাকশনের পরিশুদ্ধ আইডিয়া ও প্ল্যানিং নিয়ে ফিরে আসে।

পরিশেষে বলব, এসব কথায় কান দেয়ার বা তাদের গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই। সামনে কুরবানী আসছে, ঠিক দুই-তিন দিন আগে কয়েকটি মিডিয়া কুরবানীর অর্থনৈতিক দিক নিয়েও এরকম নিউজ অটো পাবলিশ করবে। সেগুলো পড়েও সময় নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। আগের স্ট্যাটাসে যেমনটা বলেছিলাম, পৃথিবীর এত মানুষকে একই সময়ে, বা এর কাছাকাছি সংখ্যক মানুষও কোনো আন্তর্জাতিক ফেয়ার একত্রিত করতে পারে নি।

আবরাহারও এ কষ্ট ছিল। সে চেয়েছিল কাবা ধ্বংস করে নিজ দেশে এরকম মানুষ একত্রিত করার মতো কিছু বানাবে, যার চারপাশে মানুষ তাওয়াফ করবে। তাই সে অভিনব কায়দায় হাতির বাহিনী নিয়ে কাবা ধ্বংস করতে গিয়েছিল। সামান্য আবাবীলের তাড়া খেয়ে ব্যর্থ হয়েছে। এ কষ্ট প্রত্যেক যুগে আবরাহার উত্তরসূরিদের। তাদের জন্য আফসোস ছাড়া কিছু করার নেই।

আল্লাহ তাদের সুবুদ্ধি দিন, হেদায়াত দিন। আমীন।

===

সংযোজন: পোস্টটিতে বক্তার কথার শরয়ী বিধান এবং সে কথার প্রেক্ষিতে তার শরয়ী অবস্থান ও আমাদের করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয় নি। বিষয়টি পোস্টের শুরুতেই স্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে। বক্তা হজ্জ্বের ইকোনোমিক দিক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা হলো, হজ্জ্ব এমন একটি ইবাদত যার কোনো সামাজিক-অর্থনৈতিক মূল্য নেই। এতে কোনো প্রোডাকশন নেই, আছে কেবল রিডাকশন – তার মতে। তাই সেদিক থেকেই পোস্টে আলোচনা করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ইসলামের প্রতিটি ইবাদতেরই সামাজিক অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। মূর্তি পূজারীরা মূর্তি পূজা করে পানিতে ফেলে দেয়, অনেক অর্থ এখানে একদম নষ্ট করা হয়। ইসলামে এমন কিছু নেই। জাকাত, হজ্জ্ব, কুরবানী – প্রতিটি ইবাদতই ইবাদতের পাশাপাশি এতে সমাজের ও অর্থনীতির অপার উপকারিতা রয়েছে। এটা ইসলামের অসংখ্য সৌন্দর্যের একটি। এখানে ইবাদত ও আল্লাহর ফাদল (রিযিক) অন্বেষণ পাশাপাশি চলে। বরং হালাল রিযিক অন্বেষণও ইবাদত বলে গণ্য। কারণ এতে আল্লাহর নির্দেশের অনুসরণ হয়।

ইসলামের যে কোনো প্রতিষ্ঠিত বিষয় অস্বীকার করলে ব্যক্তি মুরতাদ হয়ে যায়। ঠাট্টা/ বিদ্রূপ করাও অস্বীকারের নামান্তর। সেখানে সরাসরি ইসলামের অন্যমত বৃহত্তম রুকন হজ্জ্বের ‘বিরোধী’ বলা হলো। এর পরিণামে ব্যক্তির শরয়ী বিধান কী হয় – তা আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই।

ইসলামে মুরতাদের বিধান হলো, তাকে প্রথম বন্দী করা হবে, তাওবা করানো হবে। তাওবা করতে অস্বীকৃতি জানালে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে।