তালাক ও মোহরানা – একটি মন্তব্য

প্রথম আলো ব্লগে একটি পোষ্টে আলোচনা প্রসঙ্গে নিচের মন্তব্যটি করি। আর্কাইভ করে রাখার জন্য এখানে পোষ্ট করছি।

আমার মন্তব্য : আপু, পোষ্টটির জন্য অনেক ধন্যবাদ। আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন। আমীন।
তবে দুটো পয়েন্ট নিয়ে একটু বলতে চাই..

১. আপনি বলেছেন, “স্বামীর সাথে র্নিজনবাস বা সহবাসের র্পূবে তালাকের ক্ষেত্রে – স্ত্রীর অভিভাবক স্ত্রীর তরফ থেকে মোহর মাফ করতে পারে”।

>> স্বামীর সাথে নির্জনবাসের পূর্বে তালাক হলে বিধান হলো, মোহর পূর্ব নির্ধারিত থাকলে স্ত্রী অর্ধেক মোহর পাবে। আর পূর্ব নির্ধারিত না থাকলে স্ত্রী কেবল কিছু উপটৌকন (জামা-কাপড় ইত্যাদি) পাবে। আর মোহর সর্বাবস্থায়ই স্ত্রীর অধিকার। মাফ করলে স্ত্রীই করবে। স্ত্রীর অসম্মতিতে তার পরিবার তার তরফ থেকে মাফ করাতে পারবে না।

২. … যা আজকের বাংলাদেশী টাকায় ২৩৪৩৮৭.৫ টাকা ( ১ দিরহাম=১৮.৭৫১ টাকা)। আর এটাই মহানবী (সা ) তাঁর স্ত্রীদেরকে মোহরানা হিসেবে প্রদান করেছিলেন। তার মানে এই নয় যে, প্রত্যেক মুসলমান স্বামী তার স্ত্রীকে এ বিশাল অংকের মোহরানা দিতে বাধ্য। সবার পক্ষে তা দেয়া সম্ভবও নয়। এটি বরং বিবাহের মোহরানা র্নিধারণের একটি আর্দশ হিসেবে আমরা মনে রাখতে পারি,…

>> এটা হয়ত নবীজীর স. কোনো স্ত্রীর ক্ষেত্রে ছিল। তবে নবীজীর স. উম্মতের জন্য যে পরিমাণটি মুস্তাহাব সেটি হলো, যা তিনি তাঁর প্রিয় কণ্যা ফাতিমা রা. –এর বিবাহে নির্ধারণ করেছিলেন। তার পরিমাণ ছিল ৫০০ দিরহাম। বর্তমান বাংলাদেশি টাকায় এর মূল্য হবে ৬৫,৬২৫ টাকা মাত্র। এটাকে মহরে ফাতেমী বলে। তবে সর্বাবস্থায় মোহর নির্ধারণ করতে হবে স্থান, কাল, পাত্র ভেদে উভয় পক্ষের সম্মতিতে। মহরে ফাতেমী বা নবীজী স. পদ্ত্ত মোহর ওয়াজীব কোনো বিষয় নয় যে এর জন্য ঝগড়াঝাটি করতে হবে। আর মোহর এ পরিমাণই ধার্য করা উচিৎ, যা পরিশোধ করা সম্ভব। লোক দেখানো মোটা অংক নির্ধারণ করে স্ত্রীর কাছ থেকে মাফ করিয়ে নেয়া কখনোই উচিৎ নয়। মোহর স্ত্রীর অধিকার, তার প্রাপ্য। জোর করে তাকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা নির্লজ্জের কাজ।

আপনার পোষ্টটা প্রিয়তে রেখে দিলাম। অনেকে উপকৃত হবেন, ইনশা’আল্লাহ। ভালো থাকুন।

লেখিকার মন্তব্য :

১ম পয়েন্টটা ২য় র্পবে আলোচনা করেছী ভাইয়া।স্ত্রীর অসম্মতিতে তার পরিবার তার তরফ থেকে মাফ করাতে পারবে না।—-এটা আমি নেট (IslamOnline.com) থেকে জেনেছি যে, স্ত্রীর অভিভাবক মোহর মাফ করতে পারে র্নিজনবাস বা সহবাসের র্পূবে। আপনি কি ওটা একটু দেখবেন?

তবে নবীজীর স. উম্মতের জন্য যে পরিমাণটি মুস্তাহাব সেটি হলো, যা তিনি তাঁর প্রিয় কণ্যা ফাতিমা রা. –এর বিবাহে নির্ধারণ করেছিলেন। তার পরিমাণ ছিল ৫০০ দিরহাম। বর্তমান বাংলাদেশি টাকায় এর মূল্য হবে ৬৫,৬২৫ টাকা মাত্র। এটাকে মহরে ফাতেমী বলে।————এ ডাটাটা পাইনি কোথাও। অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে দেয়ার জন্য।

আমি আপনাকে মেসেজ দিয়ে পোস্টটার কথা জানাবো ভেবেছিলাম। আপনি নিজে থেকেই এসে পড়েছেন, সেজন্য থ্যাংকু। বাকি ২টি র্পবেও আপনার মন্তব্য পাবো আশা করি। যেহেতু আপনি ভাইয়া এসব বিষয়ে বেশি জানেন, তাই আপনার মন্তব্য দিয়ে আরো কিছূ জানতে পারবো, ইনশাআল্লাহ।

আমার উত্তর :

..“১ম পয়েন্টটা ২য় র্পবে আলোচনা করেছী ভাইয়া।স্ত্রীর অসম্মতিতে তার পরিবার তার তরফ থেকে মাফ করাতে পারবে না।—-এটা আমি নেট (IslamOnline.com)থেকে জেনেছি যে,স্ত্রীর অভিভাবক মোহর মাফ করতে পারে র্নিজনবাস বা সহবাসের র্পূবে। আপনি কি ওটা একটু দেখবেন?”

>> আমাদের পড়াশোনার কমন সেন্স থেকে উক্তিটি করেছিলাম। তবে আপনি যেহেতু একটা সাইটের রেফারেন্স দিলেন, তাই এ ব্যাপারে আরো পড়ে দেখব কথা দিচ্ছি, ইনশা’আল্লাহ।

“তবে নবীজীর স. উম্মতের জন্য যে পরিমাণটি মুস্তাহাব সেটি হলো, যা তিনি তাঁর প্রিয় কণ্যা ফাতিমা রা. –এর বিবাহে নির্ধারণ করেছিলেন। তার পরিমাণ ছিল ৫০০ দিরহাম। বর্তমান বাংলাদেশি টাকায় এর মূল্য হবে ৬৫,৬২৫ টাকা মাত্র। এটাকে মহরে ফাতেমী বলে।————এ ডাটাটা পাইনি কোথাও। অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে দেয়ার জন্য”।

>> ১. এই ডাটাটা না পাওয়ার কারণ হলো, নবীজীর স. নির্ধারিত এই মোহরকে আমরা (সাউথ এশিয়ানরা) যে মোহরে ফাতেমী বলি, তা অন্যরা বলেন না। কারণ, হাদীসে একে এ নামে পরিচিত করানো হয় নি, বা, এ পরিমাণকে আমাদের উপর চাপিয়েও দেয়া হয় নি। তবে সাউথ এশিয়ান ওলামায়ে কেরাম নবীজীর স. ছোট থেকে ছোট সুন্নতের ব্যপারেও বেশ আবেগপ্রবণ, কাজেই এই ছোট সুন্নতটিকেও তাঁরা ছাড়েন নি। বরং, অনেক আলেম তো মহরে ফাতেমী না থাকলে সেই বিবাহে উপস্থিতই হননি। যাহোক, এটা তাঁদের ব্যাপার। তবে মহরে ফাতেমী কোন ওয়াজীব বিষয় নয় যে ঝগড়াঝাটি করতে হবে, এটা আগেও বলেছি, আবারও বললাম।

২. গতকাল আপনার উল্লিখিত হাদীসের ক্ষেত্রে আপনি যে হিসাব দিয়েছেন, তা আর কোথাও শুনি নি বলে মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, প্রথম শুনলাম যে নবীজী স. তাঁর স্ত্রীকে এত বেশি মোহর দিয়েছেন। তাই তৎক্ষনাৎ এ কথা বলেছিলাম যে, “এটা হয়ত নবীজীর স. কোনো স্ত্রীর ক্ষেত্রে ছিল। তবে নবীজীর স. উম্মতের জন্য যে পরিমাণটি মুস্তাহাব সেটি হলো….”

আজ হাদীসটির মূল আরবী দেখার পর বিষয়টা ক্লিয়ার হলো। আসলে হাদীসটির (মুসলিম:৩৫৫৫) অনুবাদে একটু ভুল হওয়ার কারণে সব উল্টা পাল্টা হয়ে গেছে।
আপনি বলেছেন, “…এটা হল উক্কিয়ার অর্ধেক আর ৫০০ দেরহামের সমতুল্য”। আসলে অনুবাদটা হবে এরকম: “নাশ হলো এক উকিয়ার অর্ধেক। (কাজেই সর্বমোট সাড়ে বারো উকিয়া হলো,) যা ৫০০ শত দিরহামের সমতূল্য। অর্থাৎ মোট সাড়ে বারো উকিয়ার মূল্য হলো ৫০০ দিরহাম। অর্থাৎ, নবীজী স. তাঁর কোনো স্ত্রী বা কণ্যার ক্ষেত্রেই ৫০০ দিরহামের অধিক মোহর নির্ধারণ করেন নি। অতএব, তাঁদের চেয়ে বেশি সম্মান আর কার হতে পারে যে তোমরা এমন অতিরিক্ত মোহরানার জন্য মারামারি কর..?! (এই বক্তব্যটি তিরমিযী:১১১৪ নং হাদীসে ওমর রা: আরো স্পষ্ট করে বলেছেন।)

আর ৫০০ দিরহাম = ১৩১.২৫ ভরি রূপা
আর বর্তমানে ১ ভরি রূপা = ৫০০ টাকা
.:. ১৩১.২৫ ভরি রূপা = ৫০০ X ১৩১.২৫
= ৬৫,৬২৫ টাকা মাত্র।

হাদীস দুটি রেফারেন্সের জন্য যুক্ত করে দিচ্ছি:

মুসলিম:৩৫৫৫ >>

حدثنا إسحاق بن إبراهيم أخبرنا عبد العزيز بن محمد حدثنى يزيد بن عبد الله بن أسامة بن الهاد ح وحدثنى محمد بن أبى عمر المكى – واللفظ له – حدثنا عبد العزيز عن يزيد عن محمد بن إبراهيم عن أبى سلمة بن عبد الرحمن أنه قال سألت عائشة زوج النبى -صلى الله عليه وسلم- كم كان صداق رسول الله -صلى الله عليه وسلم- قالت كان صداقه لأزواجه ثنتى عشرة أوقية ونشا. قالت أتدرى ما النش قال قلت لا. قالت نصف أوقية. فتلك خمسمائة درهم فهذا صداق رسول الله -صلى الله عليه وسلم- لأزواجه.

তিরমিযী:১১১৪ >>

حدثنا ابن أبي عمر حدثنا سفيان بن عيينة عن أيوب عن ابن سيرين عن أبي العجفاء السلمي قال : قال عمر بن الخطاب ألا لا تغالوا صدقة النساء فإنها لو كانت مكرمة في الدنيا أو تقوى عند الله لكان أولاكم بها النبي صلى الله عليه و سلم ما علمت رسول الله صلى الله عليه و سلم نكح شيئا من نسائه ولا أنكح شيئا من بناته على أكثر من ثنتي عشرة أوقية

আরেকটি প্রশ্ন ও উত্তর :

প্রশ্ন : ইউসুফ ভাই মুসলিম বিবাহের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে স্ত্রীকে ‍দেনমোহর ও মোহরানার হক প্রদানের জন্য। দুটি কি একই জিনিস? আমরা দেখি বিয়ের সময় কাবিনে দেনমোহর যত টাকা ধরা হয় তার কিছু অংশ আবার অলঙ্কার এর মূল্য বাবদ বাদ দেয়া হয়। কেউ আবার বিয়ের রাত্রে স্ত্রীর কাছে দেনমোহরে পরিশোধ না করে মাফ চেয়ে নেয়। ইসলামের দৃষ্টিকোন থেকে ব্ষিয়গুলো একটি পোষ্টের মাধ্যমে পরিস্কার করে বলার অনুরোধ থাকলো।

উত্তর : হ্যাঁ ভাই, দেনমোহর ও মোহরানা একই জিনিস। দেনমোহর হলো নারীর জন্য জীবন বীমার (Life Insurance) ন্যায়। স্বামীর মৃত্যুতে বা তালাকের পর বা অন্য কোন বিপদে যেন স্ত্রীর কোন অসুবিধা না হয়, সেজন্যই এই ব্যবস্থা। এটা কিন্তু কোনক্রমেই নারীর মূল্য নয়। মানুষ অমূল্য, তার মূল্যমান কখনোই সম্ভব নয়।

বিয়েতে যে দেনমোহর নির্ধারণ করা হয় তা পরিশোধ করা অবশ্য কর্তব্য। এমন কী স্বামী যদি তা পরিশোধ না করে মারা যায়, তা হলে তার সম্পদ হতে তা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে।

দেনমোহরের দুটো অংশ। ১. নগদ ২. বাকী। স্বামী তার নির্ধারিত দেনমোহরের কিছু অংশ নগদ দেওয়া উত্তম। অনেকে বিবাহের সময় দেওয়া উপটৌকনকে নগদ দেনমোহরের অন্তর্ভুক্ত ধরে নেয়, তা করা যেতে পারে, কোন সমস্যা নেই। আর বাকী অংশটুকু জীবনের কোন এক সময় অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। না করে তালাক দিলে, তৎক্ষনাৎ তা পরিশোধ করা আবশ্যক। অনুরূপভাবে স্বামীর মৃত্যু হলেও তার সম্পদ থেকে তা পরিশোধ করতে হবে।

আমাদের সমাজে যা হয় যে, বিয়েতে মোহরানা ধরা হয় ৫ লাখ টাকা, আর প্রথম রাত্রিতেই তা স্ত্রীর কাছ থেকে মওকুফ করিয়ে নেওয়া হয়.. এটা নিতান্তই কাপুরুষতা ও মানবতা বিরোধী। ইসলাম তো মোহরানা নির্ধারণ করে তা পরিশোধ করার জন্য, লোক দেখানোর জন্য নয়।

মোহরানার অংক এমন নির্ধারণ করা উচিৎ, যা পরিশোধযোগ্য। শুধু শুধু কোটি টাকা নির্ধারণ করে তা মাফ করিয়ে নিলে কী লাভ?!

তবে হ্যাঁ, এরপরও স্ত্রী স্বজ্ঞানে, স্বতস্ফুর্তে মাফ করে দিলে তা মাফ হয়ে যাবে। তবে বাধ্য করা বা অনুরোধ করা উচিৎ নয় কখনোই।