প্রশ্ন : আইসক্রিম, চকলেট ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত ভ্যানিলা কি হালাল?

প্রশ্ন : আসসালামু আলাইকুম, গুগল সার্চে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে হারাম খাদ্যের তালিকায় VANILLA EXTRACT পেয়েছি। এখন আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি, আমরা কাপ আইসক্রিম বলে যেগুলো চিনি সেগুলোতে ইনগ্রেডিএন্ট্স হিসেবে ভ্যানিলা থাকে। এগুলো কি হারাম হবে?

উত্তর : ওয়ালাইকুম আসসালাম। আপনার প্রশ্নটির উত্তর প্রদান করতে আমরা কয়েকটি পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করব। আশা করি বিষয়টি সহজে বুঝতে সহায়ক হবে।

ভ্যানিলা কী?

vanillaভ্যানিলা এক প্রকার স্বাদ যা ভ্যানিলা জাতের সবুজ উদ্ভিদ হতে প্রস্তুত করা হয়। পরে বিভিন্ন ধাপে পরিশোধন প্রক্রিয়া সমাপ্ত করে তাতে বিশেষ এক রকম স্বাদ ও ঘ্রাণ আনয়ণ করা হয়। ভ্যানিলা উদ্ভিদের দানা থেকে প্রাকৃতিক ভ্যানিলিন নি:সরণ করে বানানো হয় ভ্যানিলা ফ্ল্যাভার।

ভ্যানিলা দানা গুড়ো করে তাতে এ্যালকোহল মিশ্রণ করে বা মিশ্রণ ছাড়াই তৈরি হয় ভ্যানিলা এক্সট্রাক্ট ও ভ্যানিলা ফ্ল্যাভার। প্রসেসিং ছাড়া ভ্যানিলা উদ্ভিদে সেই পরিচিত ভ্যানিলিন স্বাদ ও ঘ্রাণ থাকে না। সাধারণত ভ্যানিলা স্বাদের সব খাদ্য দ্রব্যে এ্যালকোহল মিশ্রিত ভ্যানিলা ফ্ল্যাভার দেয়া থাকে। এ্যালকোহল ছাড়া ন্যাচারাল ভ্যানিলা দামে খুব বেশি হওয়ায় তা সর্ব সাধারণের ব্যবহারের বাইরেই থাকে।

স্বাভাবিক ভাবে Vanilla, Pure Vanilla, Natural Vanilla, Vanilla Flavor, Vanilla Flavoring, Vanilla Powder, Vanilla Specks and Vanilla Extract -এই সবগুলোই এ্যালকোহল মিশ্রিত থাকে। (muslimconsumergroup.com)

ইউ এস ফুড এন্ড ড্রাগ এ্যাডমিনিস্ট্রেশন FDA –এর বেধে দেয়া নিয়মানুসারে কমপক্ষে ৩৫% এ্যালকোহল মিশ্রিত ভ্যানিলাকে খাদ্যদ্রব্যের উপাদান হিসেবে উল্লেখ করতে vanilla extract লিখতে হবে। ৩৫% এর কম যে কোনো পরিমাণের এ্যালকোহল মিশ্রিত ভ্যানিলাকে উল্লেখ করতে ‘Vanilla Flavor’ লিখতে হবে। (muslimconsumergroup.com)

আমাদের দেশের আইসক্রিমে কোন ভ্যানিলা থাকে?

আমি সব আইসক্রিমের প্যাকেট হাতের কাছে পাই নি। তবে ইগলুর ভ্যানিলা আইসক্রিমের প্যাকেটে যেসব উপাদানের কথা উল্লেখ আছে, সেগুলো হলো :

Milk fat, Milk, Solids, Sugar, Glucose syrup, Veg. fat, Stabilizer, Emulsifier, Permitted food grade color and sweetened vanilla flavour.

এখানে ভ্যানিলা ফ্ল্যাভার ব্যবহারের কথা উল্লিখিত হয়েছে। পূর্বোক্ত বক্তব্যানুসারে তাতে ৩৫% এর নিচে যে কোনো পরিমাণ এ্যালকোহল থাকার সম্ভাবনা থাকে।

এ্যালকোহল কি হারাম?

এ্যালকোহল বিভিন্ন উপাদানের সংমিশ্রণে প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। এ্যালকোহল বলতে আমরা যে সবসময় মদ বা আরবী خمر বুঝে থাকি, যা সঠিক নয়।

হানাফী ফিকহ অনুযায়ী আরবী خمر বলা হয় নিম্নোক্ত উপাদানগুলোকে :

১. আঙ্গুরের রস, যা ঘন হয়ে ফেনা উঠে যায়।

২. আঙ্গুরের রস, যা পাকানোর ফলে ঘন হয়ে এক তৃতীয়াংশে পরিণত হয়।

৩. খেজুর ভেজানো পানি, যা ঘন হয়ে যায়।

৪. কিসমিস ভেজানো পানি, যা দিনের পর দিন রেখে দেয়ায় ঘন হয়ে যায়।

এই চার প্রকার উপাদান خمر এবং এগুলো কম-বেশি খাওয়া বা পান করা হারাম। এগুলো ছাড়া অন্য যেসব উপাদানে মাদকতা বা নেশা আসে, সেগুলো নেশা হওয়ার পরিমাণ খাওয়া হারাম। এর কম খেলে সমস্যা নেই।

(উল্লেখ্য, হানাফীদের এই বক্তব্য শক্তিশালী সনদবিশিষ্ট হাদীসের দ্বারা সাব্যস্ত। এখানে বিস্তারিত দলীল আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করছি না। দলীল বোঝার জন্য তথ্যসূত্রে উল্লিখিত ‘তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম’ অধ্যয়ন করার অনুরোধ জানাচ্ছি।

অপরদিকে এই মতের বিপরীতে সব রকম নেশাসৃষ্টিকারী দ্রব্যকেই خمر মনে করেন অনেক আলেম। এবং কম-বেশি সব পরিমাণকেই হারাম বলে উল্লেখ করেন। তাদের পক্ষেও হাদীসের শক্ত দলীল রয়েছে। রয়েছে শক্ত যুক্তিও। কাজেই তাদের মতকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়াকে সমর্থন করা যায় না। এখানে বলে রাখা ভালো যে, হানাফী ফিকাহর অন্যতম কর্ণধার ইমাম মুহাম্মদ রহ. সহ অনেকেই ওই মতকে সমর্থন জানিয়েছেন। আর তাদের মতানুসারে ভ্যানিলাসহ সব ধরণের এ্যালকোহল মিশ্রিত খাবার, পারফিউম ইত্যাদি ব্যবহার করা হারাম হবে। ব্রেড, কেক, বিস্কুট, আইসক্রিমা, পানীয়সহ সবকিছুই হারাম পর্যায়ে পড়বে।

অবশ্য ইবনে আব্বাস রা., ওমর রা. ও বড় বড় সাহাবীদের আমল আবু হানিফাসহ রহ. হানাফীদের ওই মতকেই সমর্থন করে, যা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। দ্রষ্টব্য : তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম)

ভ্যানিলায় ব্যবহৃত এ্যালকোহল :

ভ্যানিলায় ব্যবহৃত এ্যালকোহল যদি আঙ্গুর বা খেজুরের রস থেকে প্রস্তুতকৃত হয়, তাহলে নি:সন্দেহে তা খাওয়া হারাম হবে।

তবে অনুসন্ধানে জানা যায় যে, এতে ব্যবহৃত এ্যালকোহল খেজুর, কিসমিস বা আঙ্গুরের রস হতে উৎপন্ন নয়, আবার ভুট্টা, গম বা অন্য কোনো শস্য হতেও নয়। বরং এই এ্যালকোহল সিনথেটিক। আর্টিফিশিয়ালি বিভিন্ন উপাদানের মিশ্রণে প্রস্তুতকৃত।

কাজেই এগুলো যদি নেশা সৃষ্টি হওয়ার মতো না হয়, তাহলে এসব আহারে কোনো সমস্যা নেই (হানাফী ফিকহ অনুযায়ী)। আর আমরা পূর্বেই বলেছি যে, Vanilla flavor বললেই বোঝা যায় যে তাতে ৩৫% এর নিচে যে কোনো পরিমাণ এ্যালকোহল মিশ্রিত আছে। আর এই সামান্য পরিমাণ এ্যালকোহল নেশা সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট নয়।

উল্লেখ্য, মুফতি আব্দুল্লাহ নানা এই বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা করে উপসংহারে লিখেন, “আমার গবেষণার ফলাফল হলো এই যে, আমাদের অধিকাংশ বড় আলেমের এই মত যে, এ্যালকোহল যদি আঙ্গুর বা খেজুরের না হয়, এবং তা সামান্য পরিমাণে হয়, তাহলে ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম আবু ইউসুফ রহ. এর মতের উপর ভিত্তি করে তা আহারের/ব্যবহারের অনুমতি দেয়া যাবে।

হানাফী ফিকহের এই মতকে সমর্থন জানিয়ে যেসব আলেম এই অনুমতি দিয়েছেন তারা হলেন : মুফতি শফী উসমানী, মুফতি তাকী উসমানী, মুফতি রশীদ লুধিয়ানবী, মুফতি নিযামুদ্দীন, মাওলানা আব্দুল হক হক্কানী, মাওলানা থানুভী, মুফতি সাচা, মুফতি ইব্রাহীম দেসায়ী ও অন্যান্য উলামায়ে কিরাম।”

তবে এই অনুমতির ক্ষেত্রে অনেকেই এই শর্ত দিয়েছেন যে, এই পরিমাণ এ্যালকোহল তখনই জায়েয হবে, যখন :

১. এতে নেশা সৃষ্টি না হয়।

২. এটা আঙ্গুর বা খেজুর থেকে প্রস্তুতকৃত না হয়।

৩. এটা অযথা বিনোদনের বা বিলাসিতার জন্য আহার না করা হয়।

কাজেই যদি কারো কাছে দুটো অপশন থাকে, একটি এ্যালকোহলযুক্ত, অপরটি মুক্ত, তাহলে সতর্কতাস্বরূপ এ্যালকোহলমুক্তটিই গ্রহণ করা উচিৎ। এতে মতবিরোধের উর্ধ্বে উঠে আসা যাবে, একই সাথে তাকওয়ার পথেও অনেক ধাপ এগিয়ে যাওয়া যাবে।

আর একজন মুসলমান হিসেবে যথাসম্ভব খাবারের উৎপাদনে ব্যবহৃত উপাদান সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়া উচিৎ। এবং যথাসম্ভব নিশ্চিত হয়েই আহার করা উচিৎ। সন্দেহজনক খাদ্য আহার থেকে বিরত থাকা উচিৎ।

আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন।

(এই উত্তরটিকে আরো সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করা হবে, ইনশা’আল্লাহ। কাজেই কেউ এটা অন্য কোথাও প্রকাশ করতে চাইলে অবশ্যই সূত্র উল্লেখ করার অনুরোধ রইল।)

আরো জানতে পড়ুন :

১. তাকমিলায়ে ফাতহুল মুলহিম : ১ম খন্ড : ৫১৫-৫১৬ এবং ৩য় খন্ড : পৃ : ৪৯১-৫০৭, দারু ইহয়াইত তুরাসিল আরাবী, বাইরুত।

২. http://www.central-mosque.com/fiqh/ealcohol.htm

৩. http://www.sunniforum.com/forum/showthread.php?31590-Use-of-Ethyl-Alcohol-in-Food-Drinks-and-Its-permissibility!&p=270469&viewfull=1#post270469

৪. http://www.eathalalonly.com/2009_02_01_archive.html