তিন খলীফার (রা.) প্রতি আহলে বাইতের আনুগত্য ও ভালবাসা

শিয়াদের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো ইসলামের প্রথম তিন খলীফা তথা আমীরুল মু’মিনীন সায়্যিদুনা আবু বাকার আস-সিদ্দীক রা., আমীরুল মু’মিনীন সায়্যিদুনা উমার আল-ফারুক রা. ও আমীরুল মু’মিনীন সায়্যিদুনা উসমান যুন-নূরাইন রা. কে অসম্মান করা। বরং আরো মারাত্মক অপবাদ দেয়া, যে তাঁরা আমীরুল মু’মিনীন সায়্যিদুনা আলী রা. থেকে খেলাফত ছিনিয়ে নিয়েছেন, নাঊযুবিল্লাহ।

তিন খলীফার নাম তারা এমনভাবে উল্লেখ করে যেন তাঁদের চেয়ে বড় অপরাধী কেউ নেই। অথচ ইতিহাসে অসংখ্য বর্ণনা ও ঘটনা বিদ্যমান, যা থেকে প্রমাণ হয় যে, আহলে বাইত তথা রাসূল স. এর পরিবার প্রথম তিন খলীফাকে প্রচণ্ড সম্মান করতেন, এবং ভালবাসতেন। এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে আমরা তা তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশা’আল্লাহ। এখানে উল্লিখিত সকল উদ্ধৃতি শিয়াদের প্রণীত বই থেকে দেয়া।

১. আমীরুল মু’মিনীন সায়্যিদুনা আলী রা. কর্তৃক প্রথম তিন খলীফাদের প্রতি সম্মান ও ভালবাসা প্রদর্শনের অপূর্ব নমুনা হলো, নিজ সন্তানদের নাম খলীফাদের নামে নামকরণ। আলী রা. তাঁর সন্তানদের একজনের নাম রাখেন আবু বকর, অপর একজনের উমার, এবং অপর একজনের উসমান। আলী রা. এর নাতী জা’ফর রহ. এর ছেলে আব্দুল্লাহ, তাঁর এক ছেলের নাম রাখেন আবু বাকার, অপর এক ছেলের নাম মুয়াবিয়া।

২. কারবালার শহীদদের মধ্যে হুসাইন রা. এর সাথে ছিলেন তাঁর ভাই আবু বাকার বিন আলী বিন আবু তালিব, এবং হুসাইন রা. এর সন্তান আবু বাকার। (কাশফুল গুম্মাহ ২/৬৬) অথচ শিয়ারা এ নামগুলো কারবালার স্মরণে গোপন করে থাকে।

৩. আলী রা. তাঁর খুতবায় বলেন, এ উম্মতে নবীদের পর শ্রেষ্ঠ মানুষ আবু বাকার ও উমার। (আল-শাফী ফিল হাদীস, আলামাল হুদা, পৃ ৪২৮)

৪. আলী রা. প্রথম দুই খলীফা -আবু বাকার ও উমার রা. এর ব্যাপারে বলেন, “আমার বিশ্বাস মতে ইসলামের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি সবচেয়ে কল্যাণকামী ছিলেন খলীফা সিদ্দীক রা. এবং খলীফা ফারুক রা.। আমার জীবনের কসম, তাদের স্থান ইসলামে সুউচ্চ। আল্লাহ তাঁদেরকে রহম করুন তাঁদের কৃতকর্মের সর্বোত্তম জাযা দিন”। (মায়সাম,শারহু নাহজিল বালাগাহ ১/৩১)

৫. রাসূল স. পরিবারের অন্যতম সদস্য ইবনে আব্বাস রা. আবু বাকার সিদ্দীক রা. এর ব্যাপারে বলেন, “আল্লাহর কসম তিনি ছিলে ফকীরদের প্রতি দয়াশীল, কুরআনের পাঠক, অসৎ কাজের নিষেধকারী, দ্বীনের ব্যাপারে জ্ঞাত, আল্লাহর ভয়ের ভীত, হারামের প্রতি ভীতি প্রদর্শনকারী, সৎ কাজের নির্দেশদাতা, রাতে দণ্ডায়মান, দিনে রোজাদার। খোদাভীতির ক্ষেত্রে তিনি তাঁর সাথীদের ছাড়িয়ে গিয়েছেন”। (নাসিখুত তাওয়ারীখ ৫/১৪৩-১৪৪)

৬. আবু বাকার সিদ্দীক রা. এর প্রশংসা করার পর আলী রা. বলেন, “আল্লাহর গজব পড়ুক তার ওপর, যে তাঁকে অসম্মান করে বা অপমান করে”। (নাসিখুত তাওয়ারীখ ৩/৬০)

৭. শিয়াদের নিকট পঞ্চম নিষ্পাপ ইমাম, ইবনে যাইনুল আবিদীন, তাঁর কাছে একবার আবু বাকার সিদ্দীক রা. এর প্রসঙ্গ আসলে তিনি ‘সিদ্দীক’ বলে নাম নেন। উপস্থিতিরা বলেন, আপনি ‘সিদ্দীক’ বললেন? তিনি ঝট করে লাফিয়ে উঠেন, ক্বিবলার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেন, হা ‘সিদ্দীক’। যে তাঁকে সিদ্দীক (সত্যবাদী) বলবে না, আল্লাহ যেন দুনিয়া-আখিরাতে তার কোনো কথাই সত্য না করেন। (কাশফুল গুম্মাহ ২/১৪৭)

৮. উমার ফারুক রা. এর প্রশংসা করার পর আলী রা. বলেন, “যে তাঁকে অপমান করে, তাকে যেন আল্লাহ তায়ালা ক্বিয়ামত পর্যন্ত লা’নত করেন”। (নাসিখুত তাওয়ারীখ ৩/৬০)

৯. আলী রা. তাঁর কন্যা উম্মে কুলসুমকে (ফাতিমা যাহরা রা. এর ঔরসের) উমার রা. এর সাথে বিবাহ দেন।

১০. ইবনে আব্বাস রা. বলেন, আল্লাহ তায়ালা আবু হাফসকে (উমার রা. কে) রহম করুন। আল্লাহর কসম, তিনি ছিলেন ইসলামের বন্ধু, ইয়াতীমদের আশ্রয়, ইহসানের চূড়া, ঈমানের আবাসস্থল, দুর্বলের আশ্রয়। তিনি আল্লাহর হকের ওপর সবরের সাথে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, যত দিন না দ্বীনের বিজয় হয়েছে, দেশ বিজয় হয়েছে এবং মানুষের নিরাপত্তা হয়েছে। (মুরূজুয যাহাব ৩/৫১)

১১. বিদ্রোহীরা যখন উসমান রা. এর ঘরকে ঘিরে ফেলে, তখন আলী রা. নিজে তা প্রতিহত করার চেষ্টা করেন, এবং তাঁর দুই সন্তান – হাসান ও হুসাইন রা. কে পাঠান। (শারহু নাহজিল বালাগাহ – ইবন আবিল হাদীদ, ১০/৫৮১)

১২. উসমান যুন নূরাইন রা. এর প্রশংসা করার পর আলী রা. বলেন, “যে তাঁকে লা’নত করে, আল্লাহ তাঁর ওপর অভিশাপকারীদের অভিশাপ দিন”। (নাসিখুত তাওয়ারীখ ৩/৬০)

১৩. আলী রা. নিজেই বলেন, যখন আমি রাসূল স. কে ফাতিমার সাথে বিবাহের কথা বললাম, তিনি বলেন, তোমার বর্ম বিক্রয় করে মূল্য নিয়ে আস, যেন তোমার ও আমার মেয়ে ফাতেমার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করতে পারি। আলী রা. বলেন, অত:পর আমি আমার বর্ম নিয়ে বাজারে গেলাম, এবং আমার বর্ম চার শত দিরহামে উসমান বিন আফফান রা. এর কাছে বিক্রয় করলাম। যখন আমি দিরহাম গ্রহণ করলাম এবং উসমান আমার কাছ থেকে বর্ম নিলেন, তিনি বললেন, হে আবুল হোসেন! আমি কি এই বর্মের ব্যাপারে তোমার চেয়ে অগ্রগামী নই এবং এই দিরহামের ব্যাপারে তুমি? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বলেন, এই বর্ম আপনাকে হাদিয়াহ, আমার পক্ষ থেকে। আলী রা. বলেন, অত:পর আমি বর্ম এবং দিরহাম দুটো নিয়েই রাসূলের স. সামনে রাখলাম, এবং যা ঘটেছে তা জানালাম। তিনি উসমান রা. এর জন্য কল্যাণের দুয়া করলেন। (কাশফুল গুম্মাহ ১/৩৫৯)

এরকম অসংখ্য উদাহরণ ও ঘটনা তাদের বইতেই ভুরিভুরি। তাদের কাছে প্রসিদ্ধ বই ‘নাহজুল বালাগাহ’ – যা আলী রা. এর বিভিন্ন বক্তব্য, খুতবা, চিঠি-পত্র ইত্যাদির সংকলন, তাতে আলী রা. এ অনেক বক্তব্য রয়েছে যেখানে প্রথম তিন খলীফাদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়াও তাদের অনুসৃত অন্যান্য ‘নিষ্পাপ’ (তাদের মতে) ইমামদের বক্তব্যেও সেসব ফুটে ওঠে।

অথচ বর্তমান শিয়াদের বক্তব্য, লেখনী ও আচরণ পড়লে ও দেখলে মনে হবে যে প্রথম তিন খলীফা আহলে বাইত তথা রাসূল-পরিবারের শত্রু ছিলেন, নাঊযুবিল্লাহ। আল্লাহ তায়ালা তাদের ভণ্ডামি উম্মাহর সামনে প্রকাশ করে দিন। আমীন।

আরো দেখুন:
১. মুহাম্মাদ সাক্বার, আল-শি’য়া হুমুল আদুউ’ ফাহযারহুম
২. ইহসান ইলাহী জহীর, আল-শি’য়া ওয়াল সুন্নাহ
৩. ইহসান ইলাহী, আল-শি’য়া ওয়া আহলুল বাইত