মালিবাগ জামেয়ার ৩০ সালা দস্তারবন্দী মহাসম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে বাংলাদেশে এসেছেন আমেরিকার দারুল উলুম মেরিল্যান্ডের প্রিন্সিপাল মাওলানা ইরফান কবির উদ্দিন। তিনি একাধারে বহুভাষাবিদ, ইসলামিক স্কলার এবং দীন প্রচারক। বাঙ্গালী বংশোদ্ভুত এই আমেরিকানের সঙ্গে কথা হয় তার জন্য নির্ধারিত হোটেল লবিতে। তিনি তার স্বদেশ আমেরিকা এবং পিতৃভূমি বাংলাদেশের ইসলাম ও ইসলামের সেবক আলেমদের নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন। জুমার নামাজের প্রাক্কালে প্রায় বিশ মিনিট ব্যাপী সেই কথোপকথনের চুম্বকাংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
ইঊসুফ সুলতান : আপনি তো দারুল উলুম মেরিল্যান্ডের প্রিন্সিপাল। আমেরিকায় এ রকম দারুল উলুম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কি সরকার অনুমতি দেয়?
প্রিন্সিপাল ইরফান : হ্যাঁ,তাদের রুলস এন্ড রেগুলেশনস মেনে করলেই হয়। যেমন ধরুন,তারা বলে দেয়, এমন জায়গায় করতে হবে,এমনভাবে করতে হবে ইত্যাদি। এরকম কিছু শর্ত মানলেই হয়।
ইঊসুফ সুলতান : আচ্ছা কী ধরনের শর্ত দেয়া হয় সেখানে?
প্রিন্সিপাল ইরফান : ভিন্ন কোনো শর্ত নয়। অন্যান্য ইন্সটিটিউশনের যে শর্ত, ইসলামি ইন্সটিটিউশনগুলোর জন্যও একই শর্ত।
ইঊসুফ সুলতান : আচ্ছা,দারুল উলূম মেরিল্যান্ড থেকে যারা গ্রাজুয়েট হন,তারা কি সরকারিভাবে রিকগনাইজড্ হন? তাদের সার্টিফিকেট কি সরকার মূল্যায়ন করে?
প্রিন্সিপাল ইরফান : না এখনও সেরকম কিছু করা যায়নি। তবে আমরা চেষ্টা করছি যেন আমাদের আলিম কোর্সকে তারা মাস্টার্স ইন ইসলাম ধরে অন্যান্য ইউনিভার্সিটির মাস্টার্স ডিগ্রির মতো মূল্যায়ন করে।
ইঊসুফ সুলতান : এখন পর্যন্ত তাহলে কোনো দারুল উলুম এ ব্যবস্থা করতে পারেনি?
প্রিন্সিপাল ইরফান : না,এটা মাত্র শুরু হচ্ছে। দারুল উলূম মেরিল্যান্ড,দারুল উলূম বাফেলো, দারুল উলূম নিউইয়র্ক, দারুল উলূম শিকাগো– সবাই এ প্রক্রিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
ইঊসুফ সুলতান : তাহলে এখন যারা এসব দারুল উলূম থেকে গ্রাজুয়েট হচ্ছেন, তারা কর্মক্ষেত্রে কোন ধরনের অবদান রাখছেন?
প্রিন্সিপাল ইরফান : আসলে আমাদের কর্মক্ষেত্র তো অনেক বিস্তর। ওখানে অনেক মানুষ মুসলমান হচ্ছেন। অথচ সে তুলনায় মাদরাসা বা দীনি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুব নগন্য। তাই তাদেরকে ইসলাম শেখানো তাদের প্রথম কাজ।
আর আলেম যদি ভালো হয়,তাহলে কেউ সার্টিফিকেট খোঁজে না। আমি আজ থেকে দশ বছর আগে আমার প্রাণপ্রিয় শিক্ষক জাস্টিস মাওলানা তাকী উসমানীকে বলেছিলাম, আমি সৌদিতে গিয়ে অনার্স-মাস্টার্স করতে চাই। তিনি বললেন,কেন? আমি বললাম,কারণ, ওখানকার সার্টিফিকেটকে আমেরিকা-ইউরোপ খুব মূল্যায়ন করে। তিনি বললেন,দারুল উলূম করাচির পরে ওখানে পড়ার তেমন কোনো মূল্য নেই।ওটা চার বছরের কোর্স। আর আমাদেরটা আট বছরের কোর্স। শোনো, আলিম কোর্সে সার্টিফিকেটের কোনো মূই। এখানে মূল্যায়ন হয় বক্তব্যের,লেখনীর। তুমি মিম্বরে বসে যখন প্রজ্ঞাপূর্ণ আলোচনা করবে,তখন কিন্তু কেউ এসে তোমার সার্টিফিকেট খুঁজবে না। পক্ষান্তরে তুমি যদি ইলমের ক্ষেত্রে গভীর পাণ্ডিত্বের অধিকারী না হও,তাহলে তোমার সার্টিফিকেট দিয়ে কোনো লাভ হবে না।
সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত কথাটি মনে আছে। এবং কেউ কখনো আমার সার্টিফিকেট খোঁজেও নি। আমাকে কোনো ইন্টারভিউর জন্য ডেকেছে বা মিডিয়াতে ডেকেছে,কিন্তু সার্টিফিকেট কেউ চায় নি।
ইঊসুফ সুলতান : আপনি হয়ত শুনেছেন যে,সরকার চাচ্ছেন বাংলাদেশে কওমী মাদরাসার সিলেবাসগুলো পরিবর্তন করে যুগোপযোগী করা হোক। আপনি কি মনে করেন না যে,সরকারের হস্তক্ষেপের আগে আমাদের আলেমদেরই এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন। যুগোপযোগী আলেম তৈরির জন্য সিলেবাসে সঠিক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন?
প্রিন্সিপাল ইরফান : আসলে উপরের ক্লাসের যে সিলেবাস, সেটাতো পরিবর্তন করা যাবে না। ইসলামের উচ্চতর ক্লাস হিসেবে সেগুলোর সিলেবাস আমাদের পূর্ববর্তী আলেমগণ সবাই একমত হয়েই প্রণয়ন করেছেন। তবে প্রাথমিক ক্লাসগুলোর সিলেবাস পরিবর্তন করা উচিৎ। বাস্তবে এটা করা হচ্ছেও। ভারতে এক রকম সিলেবাস, পাকিস্তানে এক রকম এবং সাউথ আফ্রিকায় একরকম। বর্তমান পাকিস্তানের আব্দুর রাজ্জাক সাহেব একটি আরবি শেখার বই লিখেছেন। এটা এখন অনেক জায়গায় পড়ানো হয়। আগে কিন্তু এটা ছিল না। এভাবে প্রয়োজনমতো পরিবর্তন করা যেতে পারে।
এ তো গেল ইসলামি শিক্ষার সিলেবাসের কথা। আর সাধারণ শিক্ষার ব্যাপারে আমার মতামত হলো, হ্যাঁ, এগুলোও প্রাথমিক ক্লাসগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ। আমার শিক্ষক মাওলানা তাকী উসমানী,মাওলানা রাফী উসমানী এবং পাকিস্তানের আলেমগণও এ মত পোষণ করেন। এটা এজন্য যে, সবাই তো আর বড় আলেম হতে পারে না। তাই যারা পিছিয়ে যাবে, তারা যেন অন্য কিছু করে জীবন কাটাতে পারে –এ ব্যবস্থা থাকা উচিৎ।
এতে দীনের কোনো নিষেধ নেই যে ইংরেজি শেখা যাবে না। মুফতি তাকী উসমানী ইংরেজি জানেন।এটা তাঁর একটি প্লাস পয়েন্ট। তিনি একইসঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে মুহাদ্দিস,মুফতি। আরবি, উর্দুর সঙ্গে ইংরেজি জানেন তিনি সমানভাবে। তাঁর সমসাময়িক অন্য যারা আছেন,তাঁর শিক্ষকবৃন্দ-কাউকেই কিন্তু বহির্বিশ্বে ডাকা হচ্ছে না। ইউরোপ,আমেরিকা সবাই তাকী উসমানীকে ডাকছে। তিনি সফর করছেন বিশ্বময়।
এর কারণ তিনি ইংরেজি জানেন। ইংরেজি এখন আবশ্যক, নেসেসারি। আগে আলেমরা যে ইংরেজি নিষেধ করতেন তার উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ বিরোধিতা। সে সময় যে কাজটি একটু হলেও ব্রিটিশদের সাদৃশ্যপূর্ণ হত, আলেমরা তা নিষেধ করতেন। মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ.ঠিক এ কারণেই সেসময় টেবিল-চেয়ারে খাওয়াকে মাকরুহে তাহরীমী বলেছেন। কেননা তখন ওটা ব্রিটিশদের কাজ ছিল। অথচ বর্তমানে আলেমরা বলেন, নিচে বসে খাওয়া উত্তম। তবে টেবিল-চেয়ারে বসেও খাওয়া যায়। এটাতে কোনো সমস্যা নেই।
বর্তমানে ইংরেজি শেখা না থাকলে আলেমরা কোথাও ইসলামের কাজ করতে পারবে না। অন্য দেশে তো পারবেই না,আমাদের নিজের দেশেও পারবে না। আলেমদের তো কাজ করতে হবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে। কিন্তু আলেমরা যদি ইংরেজি না জানে,তাহলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হবে। তারা ভাববে,এরা তো মূর্খ। তারা তখন আলেমদের থেকে দূরে দূরে থাকবে।তাদের ইন্টেলিজেন্স,সহযোগিতা তারা আলেমদের দিবে না।
আলেমরা কাজ করে যাবে ঠিকই, তবে তা নিজেদের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। সাধারণ মানুষের কাছে তা পৌঁছাবে না। ফলে সাধারণ মানুষরা ধীরে ধীরে ইসলাম থেকে দূরে সরে যাবে। আর এটাই হচ্ছে বর্তমানে।
আলেমদের কাজই তো সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়া। তাদেরকে ইসলামের কাজে লাগানো। তারা এমন কিছু করতে পারে যা একজন আলেম পারে না। ধরুন, মাদরাসার একটি সুন্দর ওয়েবসাইট দরকার। আমাদের ওয়েবসাইট কেন নিম্নমানের হবে! এটা তো মাদরাসার কোনো শিক্ষক করতে পারবে না। কারণ তারা তো হাদিস,ফিকহ নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। এটা তাদের কাজও নয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন অনেক প্রোগ্রামার আছেন যারা মুসলমান। তাদেরকে এই দীনের কাজে লাগানো যেতে পারে। এভাবে সবরকম ট্যালেন্ট ব্যবহার করে ইসলামের পক্ষে কাজ করতে হবে।
আসলে মাদরাসার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কী? মাদরাসার লক্ষ্যই তো হলো দীনের সেবা করা। দীনের সেবা কীভাবে হয়,সেটাই সর্বাগ্রে লক্ষ্য রাখতে হবে।দারুল উলুম করাচিতে তো অনেক আগে থেকেই জেনারেল এডুকেশন আছে। আমাদেরকে দশ বছর আগে ক্লাসে মুফতি রাফী উসমানী বলেছিলেন, তোমরা যদি কম্পিউটার না শেখ তাহলে আর কিছুদিন পরে লোকজন তোমাদের আন-প্যাটার্ন্ড বলবে। আর এখন তো তা-ই হচ্ছে। লোকজন আমাদের বলছে,এ তো আন প্যাটার্ন্ড লোক। এ তো কম্পিউটার জানে না।
একজন সাধক মানুষ,যিনি সম্পূর্ণরূপে দুনিয়াবিমুখ, তিনি যদি কম্পিউটার না জানেন,তাতে কোনো অসুবিধা নেই। তার ছাত্ররা বুঝে নিবে যে, সারা জীবন তিনি দুনিয়াবিমুখ হয়ে কাটিয়েছেন, ফলে কম্পিউটার না জানা তার জন্য কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু সাধারণ ছাত্ররা যদি এ কথা বলে, আমি কম্পিউটার জানি না, আমি দুনিয়াবিমুখ, তাহলে সাধারণ লোকেরা বলবে, এ তো দুনিয়াবিমুখ না,এ মূর্খ। অন্য কিছু তো ছাড়তে পারে না,কম্পিউটার ছেড়ে বসে আছে। এজন্যই রাফী উসমানী সাহেব এ কথা বলেছিলেন, যার বাস্তবতা আমরা এখন দেখতে পাই।
মুফতী রাফী উসমানী, তাকী উসমানী তো শুরু থেকেই এমন। দারুল উলূম করাচিতে কম্পিউটার ল্যাব আছে। সেখানে ইংরেজি শেখানো হয়,জেনারেল এডুকেশন আছে। আমাদের আমেরিকায় তো জেনারেল এডুকেশনকে আমরা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছি। যদি কোনো অভিভাবক এ কথা বলেনও যে, আমরা জেনারেল এডুকেশন চাই না,তবু আমরা ছাত্রকে তা পড়াব।
আমাদের অভিজ্ঞতা হল,যেসব ছাত্র জেনারেল এডুকেশন পেরিয়ে আসে, তারা ইসলামি এডুকেশন তাড়াতাড়ি আয়ত্ব করতে পারে। তারা অনেক তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী হয়। আর যারা জেনারেল এডুকেশনের ছোঁয়া মুক্ত, তারা ইসলামি শিক্ষাতেও পিছিয়ে থাকে। বাংলাদেশের মাদরাসাগুলোতেও জেনারেল এডুকেশন থাকা উচিৎ। আমি জানি না,ভারতীয় আলেমরা কেন এটা করছেন না। পাকিস্তানি আলেমরা তো করছেন।
ইঊসুফ সুলতান : পুরো বিশ্বে দারুল উলুম থেকে যারা গ্রাজুয়েট হন,তারা মিডিয়ার ব্যাপারে বরাবর অনাগ্রহী। ফলে অন্যরা এ জায়গা দখল করে ফেলছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা ভুল মাস’আলা বর্ণনা করে মানুষকে বিপথগামী করছে। আমাদের দেশে কদিন আগে এক টিভি চ্যানেলে একটি ভুল মাস’আলা বর্ণনা করা হয়। যা আজও অনেক মানুষ পালন করছে। আপনি কি মনে করেন আমাদের আলেমদের মিডিয়াতে আসা উচিৎ?
প্রিন্সিপাল ইরফান : হ্যাঁ,আমাদের আলেমদের মিডিয়াতে আসা উচিৎ। তাহলে এসব ভুল ফাতওয়া প্রচারকারীদের দৌরাত্ব কমে যাবে। তবে আমাদের বড়রা যা নিষেধ করেন,সেটাও কিন্তু ঠিক। কারণ যুবকশ্রেণীর আলেম যদি কোনো বড় আল্লাহওয়ালা আলেমের তত্ত্বাবধানে না থাকে,তাহলে মিডিয়াতে গিয়ে সে খ্যাতির পেছনে পড়বে।ফলে, অহংকার এসে তার ভেতরে দীন নষ্ট করে দেবে।
মুফতি তাকী উসমানী ও মুফতী রাফী উসমানীকে তাদের শিক্ষক ডা. আব্দুল হাই আরেফী রহ. দশ বছর বয়ান করতে নিষেধ করেছেন। এটা কেন? যেন তারা খ্যাতির পেছনে না পড়েন।একথা যেন তাদের মনে না হয় যে,সবাই আমার বয়ান শুনছে,সবাই বাহবা দিচ্ছে ইত্যাদি।
এখন বড় কোনো আল্লাহওয়ালা আলেম যদি মিডিয়াতে যান, তাহলে তো তিনি দীনের স্বার্থেই যাবেন। তার যাওয়াও উচিৎ।ওরকম যদি কোনো যুবক আলেমও থাকে,যে তার মুরব্বী আলেমের অনুমতি সাপেক্ষে মিডিয়াতে যায়,সেও যেতে পারে। তবে এমনি বর্তমানে যে সাধারণ যুবক আলেমগণ, তাদের তো বড় আল্লাহওয়ালা আলেমদের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই। দেখা যাবে যে, তারা মিডিয়াতে যেতে যেতে নিজেকে খুব বড় মনে করা শুরু করবে। ফলে খ্যাতির ইচ্ছা আর অহংকার তাকে গ্রাস করে নিবে।যার কারণে নিজেই ধ্বংস হয়ে যাবে। দীনের সেবা হয়ত হবে, দীনের সেবা তো আল্লাহ ফাসিক থেকেও আদায় করে নেন। এজন্যই আমাদের মুরুব্বী আলেমগণ মিডিয়াতে যেতে নিষেধ করেন। আমাকে আমার শিক্ষা মুফতী তাকী উসমানী নিষেধ করেছিলেন। আমাকে টিভিতে কয়েকবার ডেকেছিল আমেরিকায়। আমি যাই নি।
——————–
সাক্ষাৎকারটি প্রথম প্রকাশিত হয় ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০ আইবিনিউজ অনলাইনে