কুয়ালালামপুর কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামিক ব্যাংকিং কনফারেন্স

গত ২৭-২৮ অক্টোবর কুয়ালালামপুর কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক ইসলামিক ব্যাংকিং কনফারেন্স। কনফারেন্সটির মূল আয়োজক ছিল ব্যাংক রা’য়াত, সাথে ছিল ইসরাসহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠান।

কনফারেন্সের প্রথম দিনের প্রথম সেশনে ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের প্রোডাক্টে মাকাসিদে শারিয়াহ বা শরীয়াহর লক্ষ্য-উদ্দেশ্যগুলো কতটুকু প্রতিফলিত হয় তা আলোচনা হয়।

যাদের কাছে মাকাসিদে শারইয়্যাহ টার্মটা নতুন, তাদের জন্য সংক্ষেপে উল্লেখ করছি। ইমাম গাযযালী রহ. বলেন, শরীয়াহর সকল আইনকানুনের মৌলিক উদ্দেশ্য মোটামুটি পাঁচটি। সেগুলো হল, দ্বীন, প্রাণ, আক্বল বা মেধা/ বুদ্ধি, বংশ ও সম্পদের সংরক্ষণ। আধুনিক স্কলারদের মধ্যে জামালুদ্দীন আতিয়্যাহ মনে করেন, প্রথমে প্রাণ, আক্বল, এরপর দ্বীন। কারণ প্রাণ টিকে থাকা দায় হয়ে উঠলে অনেকের পক্ষেই দ্বীন ধরে রাখা যায় না। আর এই প্রাণ টেকানোর জন্যই অনেকে দ্বীন বিকিয়ে দেন।

তো এই পাঁচটি বিষয় সংরক্ষণে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যাবশ্যকীয়, সেগুলো জারুরাহ। যেগুলো অত্যাবশ্যক নয়, তবে হলে এই পাঁচটি বিষয় সংরক্ষণের বিষয়টি আরো সহজ ও সুন্দর হয়, সেগুলো হাজিয়াহ। আর যেগুলো আরো বেশি, বা বিলাসিতার পর্যায়ে, সেগুলো তাহসিনিয়াহ।

যেমন, মোটামুটি একটি থাকার জায়গা থাকা জারুরিয়াহ। নিজের একটি বাসা থাকা হাজিয়াহ। একাধিক বাসা বা বিরাট বাসা থাকা তাহসিনিয়াহ। অবশ্য ব্যক্তি ও সমাজ ভেদে এগুলো ভিন্ন হতে পারে।

যা হোক, ড. মুস্তফা ওমর ফারুক (অর্থনীতি বিভাগ, আইআইইউএম) তাঁর প্রেজেন্টেশনে মূলত যেটা ফোকাস করেন, সেটা হলো, ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট প্রসেসে কন্সেপ্টচুয়ালাইজেশনের পর্যায়েই, অর্থাৎ যখন প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট প্রসেসটা শুরুর দিকে, চিন্তা-ভাবনা চলছে, তখনই এই পাঁচ মাকাসিদ কীভাবে প্রোডাক্টটি ফুলফিল করছে তা দেখতে হবে। সাধারণত প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট শেষ হওয়ার পর মাকাসিদের সাথে একে মেলানো হয়, কিন্তু তা ঠিক নয়, বরং শুরুতেই মাকাসিদ থেকে প্রোডাক্ট ডেভেলপ করা উচিৎ।

এবং এ ক্ষেত্রে তিনি ডাটা বা তথ্যের সহযোগিতা নেয়ার ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি উল্লেখ করেন, তিনি ও তাঁর টিম একবার প্রায় ৮০ টি দেশের স্বাস্থ্যখাতের ওপর একটি গবেষণা করেন (জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের তথ্য নিয়ে)। দেখা যায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিকমেন্ডেশন অনুযায়ী অনেক দেশই এখনও জারুরাহ অতিক্রম করতে পারে নি। অর্থাৎ যতজন লোকের জন্য কমপক্ষে যতজন ডাক্তার প্রয়োজন, ততজনের চেয়ে ঢের কম রয়েছে। যেমন একটি দেশে এক লক্ষ্য মানুষের জন্য মাত্র একজন ডাক্তার রয়েছে -এমনও আছে। কাজেই এসব দেশে অবশ্যই স্বাস্থ্যখাতে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যদিকে মালয়েশিয়ার অবস্থা এক্ষেত্রে তাহসিনিয়্যাহর পর্যায়ে। কাজেই তারা অন্য খাতে নজর দিতে পারে, যেমন, আবাসনখাতে। ইত্যাদি।

ইসলামিক ব্যাংকিংয়ে মাকাসিদ নিয়ে আরো কয়েকজন আলোচনা করেন।

দ্বিতীয় সেশনে ব্যাংক রা’য়াতের একটি প্রোডাক্ট নিয়ে আলোচনা হয়। প্রোডাক্টটির নাম ‘আর-রাহনু’। মূলত এটা পন ব্রোকিংকে (Pawn Broking) কেন্দ্র করে। আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে একটি বিষয় সম্ভবত এখনো চালু আছে। কারো টাকার প্রয়োজন হলে স্বর্ণকারের নিকট গিয়ে স্বর্ণ বন্ধক রেখে নির্দিষ্ট সুদে টাকা ঋণ নেয়া। তো, মালয়েশিয়াতেও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কোনো এক চাইনিজ তা শুরু করেন, যা পরে ব্যাপকতা লাভ করে।

তো, এতে একাধিক সমস্যা হত। প্রথমত, স্বর্ণ ঠিকমতো মাপা হতো না, চুক্তি হত চাইনিজ ভাষায়, যা ইন্ডিয়ান ও মালে’দের কাছে অস্পষ্ট থাকত। তৃতীয়ত, সুদ ছিল মাসে ২% এবং বছরে ২৫% এর মত। তো এতে শরীয়াহ লঙ্ঘনের পাশাপাশি নানাভাবে ঋণগ্রহীতাকে জুলুমের শিকার হতে হত।

ব্যাংক রা’য়াত এটাকে ব্যাংকিং সেবার ভেতর নিয়ে আসে। এতে যাদের এমন অল্প ঋণের প্রয়োজন হয়, তারা ব্যাংকের নির্দিষ্ট আউটলেটে গিয়ে স্বর্ণ দিবে, অত্যাধুনিক মেশিনের সাহায্যে তার ক্যারেট নিশ্চিত করে মূল্য নির্ধারণ করা হবে। এরপর মূল্যের সর্বোচ্চ ৭০% ঋণ হিসেবে নিতে পারবেন। এই ঋণের ওপর কোনো সুদ নেই।

কিন্তু যে স্বর্ণটি রাখা হচ্ছে, তা রাখা হচ্ছে রাহন বা বন্ধক হিসেবে। তো, সেটা সংরক্ষণের জন্য আরেকটি ওয়াদিয়াহ চুক্তি করে স্বর্ণের মূল্যের (ঋণের নয়) ৫-৬% উজরাহ বা সেইফকিপিং ফিস নেয়া হয়। তাহলে এতে মোট তিনটা চুক্তি, ক্বারদ হাসান + রাহন + ওয়াদিয়াহ ও উজরাহ।

ব্যাংক রা’য়াতের এমডি প্রোডাক্টটির আদ্যপ্রান্ত নিয়ে উক্ত প্রেজেন্টেশন করেন।

দ্বিতীয় প্রেজেন্টেশনে যায়ন এসোসিয়েটসের পরিচালক মুহাম্মদ কামাল মুখতার পন ব্রোকিংয়ের পাশাপাশি গোল্ড ইনভেস্টমেন্ট একাউন্ট ও এর সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে আলোচনা করেন। গোল্ড ইনভেস্টমেন্ট বলতে ব্যাংক একাউন্টধারী টাকা জমা দেয়ার পরিবর্তে গোল্ড জমা দিবেন। অর্থাৎ তিনি যেদিন টাকা জমা দিবেন সেদিনে ব্যাংকের গোল্ড এক্সচেঞ্জ রেট অনুসারে এত গ্রাম গোল্ডের মূল্য জমা দিবেন। আবার যেদিন উত্তোলন করতে চাইবেন, ব্যাংকের রেট হিসেবে এত গ্রাম গোল্ড বিক্রয়ের টাকা উত্তোলন করবেন। অর্থাৎ তার নামে একাউন্টে গোল্ডের পরিমাণ লেখা থাকবে, টাকা নয়। এতে এটা টাকার তুলনায় স্বাভাবিক দৃষ্টিতে বেশি নিরাপদ হবে, মুদ্রাস্ফীতিমুক্ত হবে।

এই দুই প্রেজেন্টেশন শেষে সমালোচক হিসেবে প্যানেলিস্ট ছিলেন ইসরার সিইও প্রফেসর ড. আশরাফ ও আইআইইউএম এর ড. জাহারুদ্দীন আব্দুর রহমান। উভয়েই আর-রাহনু প্রোডাক্টটির উজরাহ কনসেপ্ট নিয়ে কড়া সমালোচনা করেন। তারা বলেন, রাহনের ক্ষেত্রে মুরতাহিন (বন্ধকগ্রহীতা) রাহেন (বন্ধকদাতা) থেকে কেবল বন্ধকী বস্তু সংরক্ষণের বাস্তব খরচ আদায় করতে পারবেন। এর চেয়ে অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করলে তা “ঋণের বিপরীতে যে সুবিধা নেয়া হয় তা রিবা” – নীতির কারণে তা রিবা হবে। ড. আশরাফ পন ব্রোকিংয়ের বদলে মুদারাবা-মুশারাকা বা একান্ত প্রয়োজনে ক্বারদে হাসান দেয়ার মত ব্যক্ত করেন।

ড. জাহারুদ্দীন গোল্ড ইনভেস্টমেন্টের সমালোচনা করেন। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, তিনি যখন একটি ব্যাংককে গোল্ড একাউন্ট খোলার পর বলেছেন, তার একাউন্টের জমা রাখা গোল্ডটা দিতে, তখন তারা অপারগতা প্রকাশ করেন। মানে মূলত গোল্ড নেই, জাস্ট টাকার লেনদেন। এটা তাহলে কীভাবে গোল্ড ইনভেস্টমেন্ট হলো। বরং এটা স্পেকুলেশনসহ নানা অসাধু তৎপরতার দরজা খুলে দিবে। এরপর তিনি এর আরো নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেন।

কনফারেন্সের দ্বিতীয় দিন প্রথম সেশনে অর্থব্যবস্থায় ব্যাংকিং কীভাবে ভূমিকা রাখে তা নিয়ে আলোচনা হয়। আর দ্বিতীয় সেশনে মালয়েশিয়ার ইসলামী ব্যাংকিং আইন (ইসলামিক ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস এ্যাক্ট ২০১৩) কতটুকু মাকাসিদে শারীয়াহ মোতাবিক, তা নিয়ে আলোচনা হয়।

কনফারেন্সের প্রথম দিন শুরুতেই মোড়ক উন্মোচন করা হয় ইসরা ও ব্যাংক রা’য়াতের যৌথ প্রকাশনা “Islamic Legal Maxims & Their Application in Islamic Finance”। বইটি মূলত কাওয়ায়িদে ফিক্বহিয়্যাহ বা ফিক্বহের মূলনীতির ওপর। এর বিশেষত্ব হলো, শুধুমাত্র মুয়ামালাতের সাথে সম্পৃক্ত কাওয়ায়িদকে আনা হয়েছে। এবং প্রতিটি কায়েদার উদাহরণ হিসেবে বর্তমান ইসলামিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাসায়েল ও আধুনিক মাসায়েল আনা হয়েছে।

বইটির উদ্বোধন করেন মালয়েশিয়ার অর্থমন্ত্রী। ওনার বক্তব্যের শুরুতে যেভাবে হামদ ও সালাত পড়া শুরু করেন, এতে কেউ তাকে আলেম ভাবলে ভুল করবেন না।

====

অনুষ্ঠানের ব্রুশার: https://drive.google.com/file/d/0B1kj1UFedNyOUFBMWF9IbkhzTkE/edit?usp=sharing

“Islamic Legal Maxims & Their Application in Islamic Finance” বইয়ের লিংক: http://www.ipublication.isra.my/product-794336.html

সকল প্রেজেন্টেশন: https://www.dropbox.com/s/54ke5nfiv1mexbk/Complete%20Presentation%20Materials.zip?dl=0