মালয়েশিয়ার শরীয়াহ কোর্ট ও সুলহ

মালয়েশিয়ার শরীয়াহ কোর্ট নিয়ে জানার আগ্রহ অনেক দিনের। সৌভাগ্যক্রমে আজ ইউনিভার্সিটিতে মালয়েশিয়ার শরীয়াহ কোর্টের ‘ফ্যামিলি সাপোর্ট’ বিভাগের পরিচালক ‘ড. মুহাম্মদ নাইম’ এর একটি প্রেজেন্টেশন ছিল। জানার সুযোগ হলো অনেক কিছু।

ভদ্রলোকের প্রেজেন্টেশনের বিষয় ছিল ‘শরীয়াহ কোর্টে মধ্যস্থতা/ সন্ধি (সুলহ)’। আল-কুরআনে বিভিন্ন সমস্যা নিষ্পত্তিতে আল্লাহ তায়ালা সুলহের গুরুত্ব তুলে ধরেন।

وَإِن طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا ۖ
যদি মুমিনদের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে। (সূরা হুজুরাত: ৯)

وَإِنِ امْرَأَةٌ خَافَتْ مِن بَعْلِهَا نُشُوزًا أَوْ إِعْرَاضًا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَن يُصْلِحَا بَيْنَهُمَا صُلْحًا ۚ وَالصُّلْحُ خَيْرٌ
যদি কোন নারী স্বীয় স্বামীর পক্ষ থেকে অসদাচরণ কিংবা উপেক্ষার আশংকা করে, তবে পরস্পর কোন মীমাংসা করে নিলে তাদের উভয়ের কোন গোনাহ নাই। মীমাংসা উত্তম। (সূরা নিসা: )

সুলহ মানে বিরোধ ঘোচানো; শান্তিপূর্ণভাবে একটি চুক্তিতে পৌঁছা। কাজেই এটি একরকম চুক্তি।

শরীয়াহ কোর্টে আলাদাভাবে সুলহ ইউনিট রয়েছে। সাধারণত এখন পর্যন্ত পারিবারিক সমস্যার ক্ষেত্রেই কেবল শরীয়াহ কোর্ট ব্যবহৃত হচ্ছে। সে হিসেবে সুলহও আপাতত কেবল বিবাহ, তালাক, শিশুর কাস্টডি গ্রহণ ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে আশা করা যায় ভবিষ্যতে অন্যান্য ইস্যুতেও শরীয়াহ কোর্ট এবং সুলহ ব্যবহৃত হবে।

উল্লেখ্য, ইন্দোনেশিয়া এবং ব্রুনাই দারুস সালামে শরীয়াহ কোর্টের পরিধি আরো ব্যাপক, কেবল পারিবারিক বিষয়াদিতে সীমাবদ্ধ নয়।

অস্ট্রেলিয়া-আমেরিকাতেও ১৯৮০-২০০০ সনের মধ্যে পারিবারিক ইস্যুগুলো মেটানোর ক্ষেত্রে মেডিয়েশন (সুলহ) এর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তবে ওয়েস্টার্ন দেশগুলো এবং মালয়েশিয়ার মেডিয়েশনের পার্থক্য হলো, মালয়েশিয়ায় মেডিয়েশন কোর্টের অধীনে হয়। আর ওসব দেশে প্রাইভেটভাবে হয়।

মালয়েশিয়ায় মেডিয়েশন বা সুলহের মাধ্যমে উভয় পক্ষ যে ফয়সালায় একমত হবে, সেটাই বিচারকের সামনে পেশ করা হবে, এবং সেটাই রায় হবে। সাধারণত এসব সমস্যা কনভেনশনাল সিস্টেমে কোর্ট জাজমেন্টের মাধ্যমে সমাধা করা হয়। সেখানে একপক্ষ মনে করে সে জিতেছে, অন্যপক্ষ মনে করে সে হেরেছে। কিন্তু সুলহের মাধ্যমে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়, তাতে উভয়পক্ষ খুশি থাকে।

সুলহের ধাপগুলো হলো:

১. কোর্টে কেস রেজিস্টার করা
২. রেজিস্ট্রার কর্তৃক তা বিচার না সুলহ হবে – তা নির্ধারণ করা। (উল্লেখ্য, সব কেস সুলহযোগ্য নয়।)
৩. সুলহ নির্ধারিত হলে, সুলহ নোটিস জারি করা হবে।
৪. নির্ধারিত দিনে উভয় পক্ষ সরাসরি উপস্থিত হবে।
৫. সুলহ কর্তৃক হয়ত সমাধান হবে, নতুবা তা বিচারকার্যে গড়াবে।

বক্তা উল্লেখ করেন, ২০০৫ থেকে কৃত সুলহের ৬০% সমাধানে পৌঁছেছে, আর বাকী ৪০% বিচারকের বিচারের অপেক্ষায় থেকেছে।

সাধারণত সুলহ নির্ধারিত হওয়া কেসসমূহে তিন মাস পর্যন্ত শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয় না। এর মধ্যে সুলহের মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছার চেষ্টা করা হয় (সাধারণত কেস ফাইলের ২১ দিনের মধ্যেই)। আর সমাধান না হলে তিন মাস পর শুনানির তারিখ নির্ধারিত হবে। এবং এরপর সাধারণ কেসের মতো তা চলবে।

সুলহের মিটিংয়ের জন্য শরীয়াহ কোর্টে বিশেষ রুম রয়েছে, বিশেষ পরিবেশসহ (বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে)। সেখানে নির্ধারিত দিনে একজন মধ্যস্থতাকারী চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে উভয়পক্ষ বসবে। কোনো পক্ষের উকিল বা প্রতিনিধি নয়, সরাসরি পক্ষদ্বয়কে বসতে হবে।

বক্তা তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, প্রথম যখন ২০০৫ এ সুলহ শুরু করা হয়, তখন প্রথম কেসটি ওনার কাছে আসে। স্বামী-স্ত্রীর ২০ বছরের সম্পর্ক, স্ত্রী সম্পর্ক শেষ করার আবেদন করে কেস করেন। তো নির্ধারিত দিনে সুলহ মিটিং শুরু হয়। তিনি প্রথমে স্বামীকে কথা বলতে বলেন। স্বামী বলেন, না, লেডিস ফার্স্ট, সেই কথা বলুক। তো তিনি স্ত্রীকে বলেন, আপনি দশ মিনিট বলুন। তো তিনি দশ মিনিট কথা বলেন। শেষে বলেন, আমি আমার কেস ফিরিয়ে নিচ্ছি।

তিনি আশ্চর্য হয়ে বলেন, আজব! আপনিই কেস ফাইল করলেন, এখন শুরুতেই কেস ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছেন, কারণ কী? তিনি বলেন, আসলে গত বিশ বছরে কখনো এমন দশটি মিনিট সে আমার কথা চুপ কর শুনে নি, আজ শুনল। আজ আমার কষ্ট দূর হয়েছে, তাই আমার কেস ফিরিয়ে নিচ্ছি।

তো, সুলহের উদ্দেশ্য আসলে দুই পক্ষের মধ্যে কথা বলার সুযোগ করে দেয়া, সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করা, এবং উত্তরণের পথ বের করে আনা। সাধারণত সুলহ মিটিং শেষ হওয়ার আগেই অনেক কেস ডিসমিস হয়ে যায়।

অবশ্য এত কিছুর পরও সুলহের আধুনিক এ প্র্যাকটিসে কিছু সমস্যা থাকছে। এখনো পূর্ণাঙ্গ কোনো গাইডলাইন তাদের নেই, নেই পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল।

যাহোক, তবু এর কার্যকারিতা অনেক বেশি। আর তাই তো আল্লাহ তায়ালা নিজে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সুলহের নির্দেশ দিয়েছেন। এবং বলেছেন আস সুলহু খাইর – সুলহই সর্বোত্তম।

আমাদের দেশেও শরীয়াহ কোর্ট চালু করার ক্ষেত্রে (যদি, কখনো..) এসব অভিজ্ঞতা কাজে লাগতে পারে।

অবশ্য বক্তা মালয়েশিয়ায় ব্যবস্থাটি শুরুর প্রাক্কালে একটি সমস্যার কথা তুলে ধরেন, যা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আরো বেশি। তা হলো, সুলহের মাধ্যমে একটি কেস খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়। আর একটা কেস যত লম্বা সময় চলে, উকিলদের তত ইনকাম বেশি হয়। তাই বিভিন্ন সংস্থা এতে ভেটো দেয়। অবশ্য অথরিটির নজর ছিল “justice delayed is justice denied” তথা বিচারে বিলম্ব হওয়া মানে ন্যায় বিচার প্রত্যাখ্যাত হওয়া। কাজেই তারা তা শুরু করেই ছাড়েন। আমাদের দেশে কী অবস্থা হবে কে জানে!

======
প্রেজেন্টেশন লিংক: https://www.dropbox.com/s/5bgp25q812s4ew4/Mediation%20in%20Shariah%20Court%20-%20INCEIF%20-%2021%20Oct%2014.pdf?dl=0