দারসের মসনদে হযরত রহ.

প্রিয় উস্তায শাইখুল হাদীস আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ. এঁর পুরো জীবনকে এক বাক্যে ব্যক্ত করতে হলে বলতে হয়, “যোগ্য উস্তাযের সুযোগ্য শাগরেদ”। প্রিয় উস্তায শাইখুল আরব ওয়াল আজম শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ. এঁর অন্ধ ভক্ত ছিলেন তিনি। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁকে তিনি আদর্শ বানিয়েছিলেন। এমনকী শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করার পূর্বে তাঁর শেষ কথা ছিল, হযরত আসছেন, আপ্যায়নের ব্যবস্থা করো, তাড়াতাড়ি।

দারসে হাদীসেও উস্তাযের যথাসাধ্য অনুকরণ করে চলতেন তিনি। পরিচ্ছন্ন পোষাকে, সুশোভিত আতরে তিনি পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে আসতেন। যেন রাজকীয় কোনো দরবারে অংশ নিতে যাচ্ছেন। দারসের রুমে সামান্যতম দুর্গন্ধ তাঁর অপছন্দ ছিল। সেজন্য সারা বছরই সুমিষ্ট ঘ্রাণের রুম স্প্রে তাঁর দারসের পূর্বে স্প্রে করা হত। এছাড়া পোষাক-আশাক ও অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে পরিপাটি থাকা তো আবশ্যক ছিলই।

দারসে সবাই মনোযোগসহ বসল কিনা, হযরতের সে দিকে পূর্ণ খেয়াল থাকত। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ তাকরীর করার দিন তিনি ভালোভাবে খোঁজ নিতেন, প্রিয় ছাত্ররা সবাই আছে কিনা।

হাদীসের দারসে প্রথমে রাসূলুল্লাহ স. এঁর ওপর দুরূদ পাঠ করা হয়, এরপর হাদীস পাঠ করা হয়। হযরত বছরের শুরুতেই তাঁর প্রিয় উস্তাযের পছন্দনীয় দুরূদ বলে দিতেন, এরপর সারা বছর ছাত্রদের পাঠে তা শুনতেন।

হাদীসে রাসূল স. যে কেউ পাঠ করবে, হযরতের তা পছন্দ ছিল না। সুললীত কণ্ঠে মায়াভরা আবেগে ক্বালা ক্বালা রাসূলুল্লাহ স. এর পাঠ শোনার প্রতি তাঁর ছিল গভীর আগ্রহ। তাই বছরের শুরুতেই কয়েকজনকে ঠিক করে দিতেন, যেন তারাই সারা বছর হাদীস পাঠ করেন। উপড়ন্তু কখনো কখনো দারসে এসে নির্দিষ্ট করেই একজনকেও পড়তে বলতেন।

হাদীস পাঠের সময় হযরতকে গম্ভীর মনে হত। যেন খুব মনোযোগসহ রাসূলের স. বাণী শুনছেন, সরাসরি রাসূলেরই স. মোবারক জবানীতে। যেসব হাদীসের ক্ষেত্রে আলোচনার প্রয়োজন হত, সেসব ক্ষেত্রে তিনি সহজ সাবলীল আলোচনায় হাদীসের বিশ্লেষণ তুলে ধরতেন।

অনেক জটিল মাসয়ালা ও কঠিন বিষয়কে খুব সহজে বুঝানোর ক্ষেত্রে হযরতের কোনো তুলনা হয় না। স্বভাবজাত হাস্যরস ও বাংলা-আরবী-উর্দু-ফার্সী কবিতায় তাঁর দারস থাকত সদা সজীব। দারসের ফাঁকে হঠাৎই চলে যেতেন প্রিয় উস্তাযের স্মৃতি-দারসে। তাঁর অমলীন স্মৃতিচারণে প্রায়ই মনে হত, এই তো, শাইখুল ইসলামই রহ. তো এখানে বসে আছেন, আমরা তো তাঁর দারসেই বসে আছি।

ফিক্বহী হাদীসের বিশ্লেষণের সময় হযরত রহ. প্রথমত ছিলেন মাদানী, এরপর দেওবন্দী, এরপর হানাফী। পূর্ববর্তী ওলামায়ে কিরামের উল্লিখিত দলীলের পাশাপাশি তিনি এমনসব চমকপ্রদ দলীল ও যুক্তি উল্লেখ করতেন, কখনো মনে হত, এসব দলীল যদি ভিন্নমতাবলম্বীরা জানত, তাহলে এখানে কোনো মতপার্থক্যই থাকত না। বিভিন্ন কিতাবে পড়ে আসা অসংখ্য দলীল ও যুক্তিগুলোকে হযরতের দলীলের সামনে কখনো অপ্রয়োজনীয় মনে হত। কিন্তু হযরত তাঁর স্বভাবসুলভ বিনয়ের চাদরে তাঁর ইলমী মাক্বাম সবসময়ই ঢেকে রাখতেন।

প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে তিনি প্রচলিত নানা মত ও ফিরক্বা নিয়ে আলোচনা করতেন। কুরআন-হাদীসের আলোকে বাতিল মতসমূহকে খন্ডন করতেন সাবলীল ভাষায়। তাঁর আলোচনা কখনো বিদ্বেষমুলক ছিল না। তিনি কখনো কোনো মতাদর্শীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতেন না। কুরআন-হাদীসের আলোকে তিনি সত্যকে সুন্দরভাবে তুলে ধরতেন। আর সত্য যখন স্পষ্ট হয়, বাতিল এমনিতেই কেটে পড়ে।

তাওহীদ, তাসাওউফ বা আধুনিক বিজ্ঞান নিয়ে কোনো আলোচনা আসলে সেগুলোও তিনি কুরআন-হাদীসের আলোকে সহজ সুন্দরভাবে তুলে ধরতেন।

দ্বীনের খিদমাত হযরতের রহ. অন্যতম প্রধান ব্রত ছিল। যে কোনো জায়েজ পদ্ধতিতে দ্বীনের খিদমাতকে তিনি সমর্থন দিতেন। তবে সবক্ষেত্রেই প্রিয় উস্তাযের মাসলাক, মত ও পথকে তিনি অগ্রাধিকার দিতেন; এবং তাঁর অনুসরণের মাঝেই প্রিয় রাসূলকে স. পাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন।

মৃত্যুর মাস দুয়েক আগে তিনি একটি অসীয়ত করে যান এবং তা সবদিকে ছড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। অসীয়তনামায় তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন, তাঁর যে কোনো বক্তব্য, কথা বা কাজকে অবশ্যই তাঁর প্রিয় উস্তায শাইখুল ইসলাম রহ. ও দেওবন্দী মাসলাকের মানদন্ডে যেঁচে নিতে হবে। এর বিপরীতে তাঁর কোনো বিষয়কে ব্যাখ্যা করা হলে তা অন্যায় হবে।

মাদানীপ্রেমিক এই মহান আলেমের মৃত্যুতে আমরা যা হারিয়েছি তা অপূরণীয়। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর চিন্তা-চেতনা ধারণ করার ও তা ছড়িয়ে দেয়ার তাওফীক দিন। আমীন।