প্রসঙ্গ ঐশী ও পথহারা প্রজন্ম

ঐশী আইনের চোখে শিশু না প্রাপ্ত বয়স্ক, তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু যে অপরাধ ঐশী করেছে, তা যে কোনো শিশু, বরং স্বাভাবিক কোনো মানুষ, করতে পারে না, বিষয়টা নিশ্চিত। সাথে সাথে এও নিশ্চিত যে, প্রজন্ম এক গভীর সংকটের ভেতর দিয়ে পথ অতিক্রম করছে। অভিভাবক মাত্রই ব্যাপারটি নিয়ে উদ্বিগ্ন।

অপ্রাপ্ত বয়স্ক কেউ কোনো অপরাধ করলে সাধারণত এটা তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে ধরা হয় না। এটা কারো দ্বারা প্ররোচিত বলে ধরা হয়। সে ক্ষেত্রে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চারপাশের মানুষেরা, বন্ধু-বান্ধব ইত্যাদি উঠে আসে।

ঐশীর আইনজীবী রানা আদালতে বলেন, “যে পরিবার ও যে সমাজ ঐশীদের তৈরি করে তাদের বিচার হওয়া দরকার।” (সোর্স: বিডিনিউজ২৪) পেশার প্রয়োজনে হলেও সত্য উচ্চারণে তাকে ধন্যবাদ। যে পরিবার ও যে সমাজ ঐশীদের তৈরী করে, বিচার তাদেরই করা উচিৎ।

খবরে জানা যায়, অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের “ও” লেভেলের ছাত্রী ঐশী। আর তার বাবা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন। তার পরিবার ও আশ-পাশের সমাজ নিয়ে আমরা একটা সাধারণ ধারণা এর মধ্যে পেয়ে যাই।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ঐশী একটি উচ্চবিত্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান, সম্ভ্রান্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের “মেধাবী” ছাত্রী। সংবাদমাধ্যমগুলো অবশ্য তাকে “বখাটে” বা “বখে যাওয়া সন্তান” হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তাদের প্রচারিত নীতি অনুসারে সে অবশ্যই একজন স্মার্ট ও যুগ সচেতন মেয়ে।

অধিকার নিয়ে সুশীল সমাজ যখন খুব সচেতন, তখন ঐশী তো তার সুন্দর লাইফস্টাইলের অধিকারের জন্যই লড়াই করেছে। যদিও লড়াইটা যাদের ছাড়া লাইফ “ইম্পসিবল”, সেই তাদের পাল্লায় পড়ে একটু “এ্যাগ্রেসিভ” হয়ে গেছে, এই যা। তবু সে অনুতপ্ত, আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সে বলেছে, “মা-বাবার জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে।”

ঐশীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। জাগতিক সম্মান অর্জনের কি নেই এই প্রতিষ্ঠানে! স্টাডি ট্যুরে প্রতি বছর আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলোতে পাঠানো হয় ছাত্র-ছাত্রীদের।

ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত সিলেবাসে ধর্মের নামমাত্র উপস্থিতিও আছে। কিন্তু ওপরের ক্লাসে, এইট, নাইন ও টেনের সিলেবাসে ধর্ম নেই। যতদূর জানা যায়, GCE -এর ‘ও’ লেভেল পরীক্ষায় ইসলাম নেয়া যায়। কিন্তু এখানে, বরং হয়ত বাংলাদেশের অধিকাংশ ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলেই সে ব্যবস্থা করা হয় না।

ইসলাম বা ধর্মশিক্ষা যখন নেই, তখন তাদের মাদকাসক্তি, উগ্র জীবন ইত্যাদি তো হবেই। এটাই তাদের জন্য স্বাভাববিক, উল্টোটা অস্বাভাবিক। এই যে ক’দিন পরপর রিপোর্ট বের হয় ইয়াবা ও অন্যান্য মাদক ব্যবসার ওপর, সেগুলোতে তো স্পষ্টই উল্লেখ থাকে যে ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলগুলো এবং প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরাই এসবের ক্রেতা।

যাদের পরিবারে অভাব-অনটন, তারা এসব উচ্চবিত্তের মাদক সেবনের পয়সা পাবে কোথায়! অভাবের কারণে হলেও তাদের পারিবারিক বন্ধন টিকে থাকে। কিন্তু যাদের এই বাধা নেই, তাদের আর ইম্পসিবলদের বলয় থেকে বের করবে কে!

ঐশীর সংবাদ কভারেজে ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মাদকের উল্লেখ বেশ লক্ষণীয়। সাধারণত কোনো মাদ্রাসার সাত বছরের শিশু যদি ভুলক্রমে কোনো মিছিলের পাশ দিয়ে হেঁটেও যায়, তবু সাংবাদিক ভাইয়েরা তার মাদ্রাসা, পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজন এর চুলচেড়া বিশ্লেষণ করে ছাড়েন। তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের ঘুম হারাম করে ছাড়েন।

একবার একটি প্রতিষ্ঠিত অনলাইন সংবাদ মাধ্যম মিছিলে একটি শিশুর ছবি দিয়ে একটি স্বনামধন্য মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের ছাত্র বলে বিশাল ফিচার করা হল। “হুজুরে যাইতে বলসে, জিহাদ করতে বলসে, তাই সে গেসে” ইত্যাদি ইত্যাদি। মজার ব্যাপার হলো, যে হুজুরের নাম আসল, সেই নামের কোনো হুজুরই মাদ্রাসায় নেই, ছাত্র তো দূরের কথা। মাদ্রাসার নামটাও ‘বেচারা’ সঠিক লিখতে পারেন নি। কিন্তু মুখরোচক আগ-পিছ মিলিয়ে, হয়ত বা পুরনো কোনো নিউজকে কপি-পেস্ট করে পাঠকপ্রিয় একটি নিউজ করে ফেললেন।

এবার ঐশী প্রসঙ্গে ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। সংবাদ পড়ে জানা যায়, ঐশী অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ক্লাস এইটে ভর্তি হওয়ার পর থেকে তার চলাফেরায় পরিবর্তন আসে। খুব সকালে বের হওয়া ও রাত করে ঘরে ফেরা অভ্যাসে পরিণত হয়। নাচের অনুষ্ঠানে যাওয়া আসা বেড়ে যায়। এমনই কোনো এক নাচের অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় অপর এক ঘাতক বন্ধুর সাথে।

সে ক্ষেত্রে স্কুলটির পরিবেশ, পড়াশোনা, ছাত্র-শিক্ষকদের মাদক সংশ্লিষ্টতা, শিক্ষকদের মতামত, অভিভাবকদের বক্তব্য, ক্লাসমেটদের অবস্থা, নাচের অনুষ্ঠানগুলোর খোঁজ খবর ইত্যাদি নিয়ে রিপোর্ট হতে পারত। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সাংবাদিক ভাইয়েরা এ বিষয়ে নীরবতা পালন করছেন। মাদক নিয়ে কিছু লেখা আসছে, কিন্তু যে পরিবেশ মাদক নিতে শেখাল, সেই পরিবেশ নিয়ে কোনো লেখা আসছে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো অনেক দিন পর কোনো বিষয়ে কিছু বলার মত খুঁজে পেল। তাদের ধন্যবাদ, অবশেষে তাদের নিদ্রা তো ভাঙল। আমরাও মনে করি ঐশীকে রিমান্ডে নেয়া উচিৎ নয়। মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে। কিন্তু অপরাধ তো হয়েছে। কাউকে না কাউকে তো অপরাধের দায় নিতেই হবে। কে নিবে সে দায়!

পর্দার আড়ালের প্রকৃত অপরাধী সমাজকে চিহ্নিত করে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে তো ঐশীদের ওপরই দায় চাপানো হবে। আর ওদিকে তৈরী হবে আরো হাজারো ঐশী, যাদের কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে খোদ সেসব ঐশীদের বাবা-মা। সত্য স্পষ্ট হওয়ার পরও সুশীলদের এসব নীরবতা আগামীতে ঐশীময় প্রজন্মেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে!!

ঐশীর ঘটনাকে কিশোর অপরাধ বলে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। আজ দেশের প্রতিটি বাবা-মা উদ্বিগ্ন। আর লজ্জিত প্রতিটি সন্তান। এ ঘটনা বাবা-মা আর সন্তানদের মধ্যে যে একটি “সন্দেহ” রেখা টেনে দিয়েছে তা নিশ্চিত। রেখাটিকে মুছে ফেলতে আজই সচেতন না হলে আমাদের বিপর্যয় সুনিশ্চিত।

জানা যায়, ঐশী ইতোপূর্বে কয়েকবার আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। এমনই এক আত্মহত্যা-চেষ্টার পূর্বে লেখা সুইসাইডাল নোটে তার ধর্মীয় বিশ্বাসের কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। মৃত্যুপরবর্তী জীবন সম্পর্কে সে লিখেছে, “আমি জানি না মৃত্যুর পর কী হবে! দেখা যাক কী হয়! আসলে মৃত্যুর পরের জীবন বলতে হয়তো কিছুই নেই! শুধুই মাটির সঙ্গে মিশে যাবো। তাহলে তো সবই শেষ।”

মৃত্যুপরবর্তী জীবন সম্পর্কে অনিশ্চিত বিশ্বাস মানুষকে অপরাধ করতে উৎসাহিত করে। মৃত্যুপরবর্তী শাস্তি ও কবরের প্রশ্নোত্তর ইত্যাদি বিশ্বাস মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করে।
স্রষ্টার প্রতি অবিশ্বাস বা অনিশ্চিত বিশ্বাস বা অপূর্ণাঙ্গ বিশ্বাস মানুষকে হতাশায় ডুবিয়ে রাখে। ঈমানদার মানুষ কখনো চূড়ান্তভাবে হতাশ হতে পারে না। ঐশীর নোটটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, স্রষ্টা নিয়ে তার বিশ্বাস অপূর্ণাঙ্গ ছিল এবং মৃত্যুপরবর্তী জীবন তার কাছে অনিশ্চিত ছিল।

ঐশীর অপরাধের পেছনে মূল কারণ অনেকের মতেই মাদক। কিন্তু মাদক থেকে প্রজন্ম কেন বিরত থাকবে? কেন সে এই লাইফকে ফিল করার সুযোগ নষ্ট করবে? কিছু বিলবোর্ড বা মানববন্ধন বা মুখরোচক স্লোগান কি প্রকৃতপক্ষে কাউকে কখনো মাদক থেকে বিরত রাখতে পেরেছে? এসব প্রশ্নের উত্তর তাদের কাছে নেই।

আল্লাহর ভয় যদি অন্তরে না থাকে, তাহলে অন্য কোনো কিছুই তাকে মাদক ও অন্যান্য অপরাধ থেকে চূড়ান্তভাবে বিরত রাখতে পারবে না।

গভীর উদ্বেগের সাথে বলতে হচ্ছে, এ অবস্থা চলতে থাকলে, আমাদের পরিবারগুলোও এক বা দুই প্রজন্মের মধ্যে এই পরিণতির দিকে যাবে। আমাদেরকেই হয়ত সেই পরিণতির ভিকটিম হতে হবে।

সময় এখনো যায় নি। তাই আসুন, নিজের সন্তানকে যদি সত্যিই ভালবাসি, আজই তার কুরআন শেখার ব্যবস্থা করি, হাদীস শেখার ব্যবস্থা করি, দ্বীন শেখা ও প্রাকটিস করার ব্যবস্থা করি। মনে রাখুন, আপনার সন্তানের জন্য সেরা ডিপোজিট ও বেস্ট গিফট, তার দ্বীন শেখার ব্যবস্থা করা।