ড. ইউনুসের সোশাল বিজনেস ও ক্যাশ ওয়াকফ

ড. ইউনুস সাহেবের সোশাল বিজনেস নিয়ে পড়ছিলাম। পুঁজিবাদী আত্মকেন্দ্রিক ব্যবসায়িক ধারণা থেকে বের হয়ে সমাজ ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে বিনিয়োগ করাটাই সামাজিক ব্যবসা বা সোশাল বিজনেস।

এখানে কোনো সামাজিক সমস্যা (যেমন স্বাস্থ্য, চিকিৎসা) সমাধানে ব্যবসায়িক কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হবে। বিনিয়োগকারী অন্যসব ব্যবসার ন্যায় এখানে বিনিয়োগ করবেন। তবে কোনো লস বহন করবেন না এবং কোনো প্রফিট/ ডিভিডেন্ড গ্রহণ করবেন না। বরং,কোম্পানি তার প্রফিট দিয়ে নিজেকে আরো সম্প্রসারিত করবে, সেবা বাড়াবে। এক পর্যায়ে বিনিয়োগকারী তার মূল বিনিয়োগ ফেরত পাবেন, এবং তিনি অন্য কোনো সামাজিক ব্যবসায় তা খাটাবেন, ফলে তার বিনিয়োগকৃত টাকা রিসাইকেল হবে।

এর উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়, বর্তমান ব্যবসাগুলো আত্মকেন্দ্রিক, এবং এর মূল উদ্দেশ্য প্রফিট ম্যাক্সিমাইজেশন। প্রফিট যেখানে নেই, সেখানে বিনিয়োগের কোনো আগ্রহ নেই। ফলে গ্রামীণ ও নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের জন্য কেউ কোনো কাজ করতে চায় না, কারণ সেখানে প্রফিট নামমাত্র। মানুষ যদি কেবল নিজকে নিয়েই ভাবে, প্রফিট ম্যাক্সিমাইজেশনের কথাই ভাবে, তাহলে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার পর কেউ তাকে মনে রাখবে না। ফলে এমন কিছু করে যাওয়া উচিৎ, যার জন্য মানুষ তাকে মনে রাখবে। এখানেই সোশাল বিজনেসের যথার্থতা।

ইসলাম প্রথমত পুঁজিবাদী একচেটিয়া প্রফিট ম্যাক্সিমাইজেশনের ধারণাকে সাপোর্ট করে না। প্রফিট হতে হবে ইনসাফপূর্ণ। সেজন্য ইসলামে বাজার উন্মুক্ত, মনোপলির কোনো জায়গা নেই। মজুদদারি নিষিদ্ধ (যদি তা বাজারের চাহিদা মেটানোর পরে হয়, তবে বৈধ)। থাকতে হবে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমান সুযোগ-সুবিধা। আর সামাজিক সমস্যা দূরীকরণ (যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি) শরীয়াহর মৌলিক উদ্দেশ্যাবলীর অন্তর্ভুক্ত। কাজেই একটি শরীয়াহ সচেতন কোম্পানি চেষ্টা করবে মানুষের মৌলিক প্রয়োজনের খাতগুলো নিয়ে আগে কাজ করতে। মৌলিক খাতগুলো শেষ হলে বিলাসপণ্যের দিকে যাবে। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ঠিক উল্টো। বিলাসপণ্যে প্রফিট বেশি থাকলে সেটাকেই অগ্রাধিকার দেয়া হবে, মৌলিক প্রয়োজন ব্যাহত করে হলেও।

সোশাল বিজনেসের কনসেপ্ট ইসলামের ক্যাশ ওয়াকফের সাথে মিলে যায়। ক্যাশ ওয়াকফ হলো রিয়েল এস্টেট ওয়াকফের বিবর্তিত রূপ, যা মূলত ষোড়শ শতাব্দীতে উসমানী খিলাফতকালে প্রসিদ্ধি পায়। ক্যাশ ওয়াকফের ক্ষেত্রে সরাসরি নগদ টাকা ওয়াকফ করা হয়। এর সুবিধা হলো, অল্প অল্প করে অনেকে ওয়াকফ করতে পারে, যা রিয়েল এস্টেট ওয়াকফের ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না।

ওয়াকফ হলো আল্লাহকে খুশি করার জন্য সামাজিক কোনো সমস্যা সমাধানে কোনো কিছু দান করা। যেমন, স্বাস্থ্যখাতের সমস্যা সমাধানে একটি জমি ওয়াকফ করা। এই জমি থেকে যা আয় হবে তা চিকিৎসা খাতে ব্যয় করা হবে। এভাবে ওয়াকফ করার সময় ওয়াকফের কজ (cause) উল্লেখ করে দেয়া যায়। ইসলামে ওয়াকফের মূল মোটিভেশন হলো মৃত্যুর পর সওয়াব পেতে থাকা। রাসূল স. বলেন, যখন মানুষ মারা যায় তখন তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়, তিনটি ছাড়া। তন্মধ্যে একটি হলো সাদাকায়ে জারিয়া বা এমন দান, যার সুফল মানুষ পেতে থাকে। [সহীহ মুসলিম: ১৬৩১]

ক্যাশ ওয়াকফের ক্ষেত্রে এক বা একাধিক ব্যক্তি নগদ টাকা/ বিনিয়োগ ওয়াকফ করে থাকে। সেই বিনিয়োগ দিয়ে সামাজিক সমস্যা দূরীভূতকারী কোনো কোম্পানি করা যেতে পারে। এই কোম্পানি থেকে কোনো প্রফিট/ লস ওয়াকফকারীরা পাবে না/ বহন করবে না। বরং প্রফিট দিয়ে কোম্পানিকে আরো বড় করা হবে, প্রোডাক্ট বাড়ানো হবে ইত্যাদি।

ওয়াকফ আর সোশাল বিজনেসের মধ্যে মৌলিক দুটো পার্থক্য নজরে পড়ে।

১. সোশাল বিজনেসের উদ্দেশ্যে মৃত্যুর পর নিজেকে পৃথিবীতে স্মরণীয় করে রাখা। আর ওয়াকফের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর কাছে এর প্রতিদান আশা করা।

২. সোশাল বিজনেসে বিনিয়োগকারী তার মূল বিনিয়োগ ফেরত পাবে। এবং পরবর্তীতে সে অন্য জায়গায় তা বিনিয়োগ করবে। ওয়াকফে ব্যক্তি তার মূল বিনিয়োগ ফেরত পাবে না, এটা পুরোপুরিই ফিলান্থ্রোপি বা দান।

মূল বিনিয়োগ ফেরত পাবার জন্য ইসলামে এমনিতেই ক্বারদে হাসান মডেল রয়েছে। যা সুদহীন ঋণ। কয়েক ব্যক্তি মিলে যে কোনো প্রজেক্টকে ক্বারদে হাসান দিতে পারে। “কে সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহকে ক্বারদে হাসান (উত্তম ধার) দিবে, এরপর তিনি তার জন্যে তা বহুগুণে বৃদ্ধি করবেন এবং তার জন্যে রয়েছে সম্মানিত পুরস্কার।” [সূরা হাদীদ: ১১]

শেষকথা, ইসলামে প্রতিটি ব্যবসাই সামাজিক ব্যবসা। সমাজের ক্ষতি হয় এমন ব্যবসা (মাদক, পর্ণোগ্রাফি ইত্যাদি) ইসলামে পুরোপুরি নিষিদ্ধ। আর ক্ষতি হয় না, তবে উপকারও হয় না, এমন ব্যবসায় ইসলাম উৎসাহ দেয় না। ইসলাম এমন ব্যবসা করতে উৎসাহ দেয়, যাতে ব্যক্তিগত প্রফিটও আছে, সামাজিক প্রফিটও আছে।

ড. ইউনুস সাহেবকে সামাজিক ব্যবসার মডেলটির জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এর মাধ্যমে তিনি স্বীকার করে নিলেন যে, পুঁজিবাদী চিন্তাধারার ব্যবসা আসলে ব্যক্তিগত কল্যাণ বয়ে আনলেও সামাজিক কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। তাই ‘সামাজিক ব্যবসা’ নামে সেখানে ভিন্ন একটি ক্যাটেগরির ব্যবসা প্রয়োজন।

===

লিংক:

সামাজিক ব্যবসা – ড. ইউনুস: https://www.youtube.com/watch?v=NnPm-otbt04http://www.muhammadyunus.org/index.php/social-business/social-business

ক্যাশ ওয়াকফ – ড. মুরাত: http://www.academia.edu/2153274/Awqaf_in_history_and_its_implications_for_modern_Islamic_economies

===

সংযুক্তি: আশা করি পাঠক গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে কনফিউজড হবেন না। গ্রামীণ ব্যাংক হলো একটি মাইক্রোফাইন্যান্স ইন্সটিটিউশন। যার উদ্দেশ্য সেসব জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেয়া যারা সাধারণত ব্যাংকিং করে না। তো, ব্যাংকিং সেবার মধ্যে মূলত মাইক্রোক্রেডিট বা ক্ষুদ্র ঋণ সেসব জনগোষ্ঠীর মাঝে সহজলভ্য করা গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্দেশ্য। আর এ ঋণ অবশ্যই সুদভিত্তিক। আর সুদ এমনিতেই জুলুম, এর ওপর তাদের সুদের হার ব্যাংকের সুদের হারের চেয়েও ঢের বেশি। যার পরিণাম সবার চোখের সামনে, ঋণগ্রহীতাদের ঘর-বাড়ি-ঘরের টিন নিলামে ওঠা, আত্মহত্যা ইত্যাদি। আসলে সুদ কখনো সমাধান নয়। সুদ চুক্তির দুই পক্ষের এক পক্ষকে অন্যায়ভাবে দেয়া মুনাফা।

সাধারণত কেউ কোনো কিছু ভাড়া দিলে (বাড়ি, গাড়ি ইত্যাদি) এর বিনিময়ে ভাড়া পেয়ে থাকে। এই ভাড়া সে পাচ্ছে কারণ সে তার সম্পদের ফিজিক্যাল ডেপ্রেশিয়েসন বা বস্তুর মূল্যহ্রাস মেনে নিচ্ছে। অর্থাৎ তার মালিকানাধীন বস্তুটি ব্যবহারের কারণে ধীরে ধীরে মূল্য হারাচ্ছে। এই ঝুঁকি বহনের বিনিময়ে সে ভাড়া গ্রহণ করছে।

কারো সাথে ব্যবসায় শরীক হলে লসের অংশীদার হতে হয়। ব্যবসায় লাভ হলে পূর্ব চুক্তিকৃত হার অনুসারে তা বণ্টন হবে। কিন্তু ক্ষতি হলে তা মূলধনের হার অনুযায়ী বহন করতে হয়। এই ক্ষতির ঝুঁকি বহনের কারণে সে মুনাফার ভাগীদার হতে পারে।

কিন্তু ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো বস্তুর অবমূল্যায়নের ঝুঁকিও নেই, আবার কোনো ক্ষতি বহন করারও ঝুঁকি নেই। তবু অতিরিক্ত কোনো টাকা নেয়াটা নিরেট জুলুম, এটা কোনো ইনসাফ নয়।

গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ পুরোপুরি সুদী ঋণ।