আগুনে পোড়া রোগীদের দুর্দশা

ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে যারা কখনো যান নি, জীবনে একবার হলেও সেখানে যাওয়া উচিৎ। আক্রান্তদের দুর্দশাগুলো নিজ চোখে দেখে আসা উচিৎ।

কয়েক বছর আগের কথা। আমার এক বোন, বয়স তখন মাত্র দুই-তিন বছর হবে। গ্রামের বাড়িতে তার মা তার ব্যাপারে একটু বেখেয়াল হতেই সে মাটির চুলায় বসানো হাড়িতে পড়ে যায়। চিৎকার শুনে আশে পাশের মানুষ এসে তাকে উদ্ধার করে।

এরই মধ্যে তার গালের একটি বড় অংশ, বগল ও পিঠের বেশ কিছু অংশ পুড়ে যায়। গ্রামে কাছাকাছি ঔষধের দোকান থেকে কিছু ঔষধ কিনে সেদিনের মতো লাগানো হয়। পরদিন দ্রুত ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে আনা হয়। সাথে আমিও ছিলাম।

ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর বার্ন ইউনিটে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে দেখে প্রথমে গ্রামে লাগানো ঔষধগুলো তুলে ফেলতে বলে। কীভাবে তুলবে জানা নেই, তুলতে হবে। আয়া বালতিতে পানি দিয়ে যায়। টয়লেটে গিয়ে বোনের মা পানিতে কাপড় ভিজিয়ে আক্রান্ত স্থানগুলোতে ঘসতে থাকেন, আর যে কোনো উপায় নেই। বোনের সে যে কী চিৎকার! আমরা কেউই সামনে থাকতে পারি নি… এরপর ডাক্তার দেখে ঔষধ দেন। এবং পরে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ দেখে যান।

ঢাকা মেডিকেলে কয়েক দিন ভর্তি ছিল সে। পোড়া জায়গাগুলোতে ব্যান্ডেজ লাগানো ছিল। সারা রাত ঘুমাতে পারত না। চুলকাতো। জ্বালা-পোড়া করত। গরমও লাগত। আবার ফ্যান ছাড়লেও কখনো সমস্যা হত। এভাবে প্রতিটা গরমের সিজনে তার কষ্টের সীমা ছিল না। এটুকু বাচ্চার এত কষ্ট!

ওদিকে চেহারার এক পাশ কালো, পোড়া। আবার মেয়ে মানুষ। বাবা-মার কষ্ট বলে বুঝানো যাবে না।

গত বছর দুয়েক ধরে একটি এনজিওর মাধ্যমে প্রায় বিনামূল্যে কসমেটিক সার্জারী করানো হচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ চেহারাটা মোটামুটি ঠিক হয়েছে, তবে শরীরে অন্য জায়গাগুলো হয়ত আর ঠিক হবে না। এ কষ্ট সারা জীবনের।

আজ শাহবাগের যাত্রীবাহী বাস পোড়ানোতে দশম শ্রেণী পড়ুয়া নাহিদ মারা গেল। আরো অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। গত কয়েক দিনে এভাবে পুড়েছেন অনেকে। কয়েক বছর পরপর এভাবেই আমরা মানুষ মারার বীভৎস উল্লাস দেখছি। অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গেছে আমাদের।

আজ হয়ত আমাদের ফেইসবুক আছে, আমরা লিখছি, নিন্দা জানাচ্ছি। সাত বছর আগে ছিল না, লিখি নি। কিন্তু আগে-পরে এমনটি যারা করছেন, সবাই সমান অপরাধী।

আপনি সরকার হন, সরকার বিরোধী হন, সাধারণ মানুষ হন, পিকেটার হন আর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হন, মানুষ কীভাবে মারেন? জীবন্ত মানুষকে কীভাবে পুড়িয়ে দেন? কীভাবে তার দিকে গুলি আর বোমা ছুড়েন? আপনি মানুষ, সেও মানুষ। মানুষ হয়ে অমানুষিক আচরণ করেন কীভাবে?

সমাজের প্রতিটা দিক উত্তরোত্তর উন্নত হয়। চিকিৎসা, শিক্ষা, কৃষি, ব্যবসা -ইত্যাদি সবকিছুর নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার হয়। স্বল্প ক্ষতিতে বৃহৎ সফলতা অর্জন করার নতুন নতুন পন্থা আবিষ্কার হয়। কিন্তু সরকার বিরোধিতা আর বিরোধীদের দমন – এ দুইয়ের কি কোনো উন্নতি হতে পারে না? নাকি এর উন্নতির দৃষ্টান্ত হলো আরো বীভৎসতা! আরো বেশি মানব মৃত্যু সয়ে যাওয়া!

আমাদের বিবেকগুলোকে কি এভাবেই মেরে ফেলতে থাকব আমরা?

====

ফলোআপ পোস্ট: https://yousufsultan.com/killing-by-fire-where-we-are/