হালাল ইন্ডাস্ট্রি – উলামায়ে কিরামের নতুন কর্মক্ষেত্র

হালাল খাবার, হালাল পানীয়, হালাল প্রসাধনী – মোটকথা হালাল ইন্ডাস্ট্রি আরেকটি বড় জায়গা যেখানে উলামায়ে কিরামের ব্যাপক অংশগ্রহণের সুযোগ আছে। বিশ্বব্যাপী এখন অনেক হালাল গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। যারা হালাল নিয়ে গবেষণা করেন, বিভিন্ন খাবারের হালালের স্ট্যান্ডার্ড প্রণয়ন করেন এবং বিভিন্ন দেশে তাদের পার্টনার রয়েছে। প্রায় ছয়-সাত বছর আগের কথা। সম্ভবত উলামা ফোরামের মাধ্যমে আমেরিকায় উলামায়ে দেওবন্দের হালাল নিয়ে কাজ করার বিষয়ে প্রথম জানতে পারি। এরপর এ বিষয়ে আরো জানার আগ্রহ তৈরি হয়।

হালাল ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কাজ করছে যেসব প্রতিষ্ঠান, তাদের অন্যতম হলো, মালয়েশিয়া সরকারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘হালাল মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়ায় যত খাবার ইম্পোর্ট হয়, এবং মালয়েশিয়ার অভ্যন্তরে উৎপাদিত হয়, সেগুলোর হালাল অবস্থা মনিটরিংয়ের জন্য এটি প্রতিষ্ঠিত। তাদের ওয়েবসাইটে হালাল বিষয়ক সাধারণ গাইডলাইন ও স্ট্যান্ডার্ড, এবং হালাল সার্টিফাইড হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেয়া আছে। এবং তাদের সার্টিফাইড বিশ্বের বিভিন্ন কোম্পানি ও তাদের পণ্যের তালিকা দেয়া আছে। অনুরূপভাবে বিভিন্ন দেশে তাদের অনুমোদিত ইসলামিক প্রতিষ্ঠানের তালিকা দেয়া আছে, যারা স্ব স্ব দেশে হালাল সার্টিফিকেশনের কাজ করছে। বাংলাদেশের কেবল ইসলামিক ফাউন্ডেশন তালিকাভুক্ত আছে। যোগাযোগের জন্য জনাব শামিম আফজাল সাহেবের নাম দেয়া আছে। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন হালাল সার্টিফিকেশনের কাজ করে জানা ছিল না!) হালাল মালয়েশিয়ার ওয়েবসাইট: http://www.halal.gov.my/v3/index.php/en/

হালাল ইন্ডাস্ট্রির আরেকটি বিশ্বস্ত নাম হালাল রিসার্চ কাউন্সিল। পাকিস্তান-ভিত্তিক এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির শাখা রয়েছে বেশ কয়েকটি দেশে। এ প্রতিষ্ঠানটি হালাল সার্টিফাই করে, ইভেন্ট আয়োজন করে এবং ট্রেনিং প্রদান করে। সাথে স্ট্যান্ডার্ডও প্রণয়ন করে। তাদের ওয়েবসাইটে প্রচুর প্রেজেন্টেশন ও গবেষণাপত্র দেয়া আছে, যেগুলো বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যায়। সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, তাদের একটি ছয় মাসব্যাপী হালাল ডিপ্লোমা কোর্স আছে, যা যে কোনো দেশে বসে করা যায়। এখানে হালালের কনসেপ্ট, গাইডলাইন, আধুনিক বিভিন্ন ইনগ্রেডিয়েন্ট বা উপাদানের কোডসমূহ, বিশেষ করে E কোড ও এর বিস্তারিত, হালাল জবেহ, বিশ্বব্যাপী হালাল ইন্ডাস্ট্রি, হালাল ব্যাংকিং, হালাল স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন ও উন্নত সেক্টরগুলোতে হালাল ইন্ডাস্ট্রির সম্ভাবনা -ইত্যাদি বিষয়গুলোতে বিস্তারিত পড়াশোনার সুযোগ আছে। হালাল রিসার্চ কাউন্সিলেরও বিশ্বব্যাপী পার্টনার রয়েছে। বাংলাদেশে তাদের পার্টনার চট্টগ্রাম-ভিত্তিক হালাল বাংলাদেশ লিমিটেড। অবশ্য তাদের ওয়েবসাইট দেখে তেমন এ্যাকটিভ মনে হচ্ছে না। হালাল রিসার্চ কাউন্সিলের ওয়েবসাইট: http://www.halalrc.org/

===

মন্তব্য: বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে এখানে ইসলামিক ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চাহিদা যেমন অনেক, তেমনি হালাল ইন্ডাস্ট্রির সম্ভাবনাও আশানুরূপ। আমার মনে হয় এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা ও উলামায়ে কিরাম – উভয় পক্ষের কাজের বিরাট ক্ষেত্র পড়ে আছে। হালাল ফল, হালাল মাছ-গোস্ত, হালাল পাউরুটি-কেক-ফ্রোজেন, যে কোনো হালাল খাবার, হালাল প্রসাধনী, হালাল সাবান, হালাল পোশাক, হালাল পানীয় – ইত্যাদি অনেক কিছু হতে পারে।

এই জায়গাগুলো নিয়ে আমরা ব্যবসায়িকভাবে চিন্তা করি না বলে অমুসলিমরা বিশাল আকারের বিনিয়োগ করে বাজার দখল করে নেয়। আমরা যারা মুসলিম ব্যবসায়ী, ইসলামের ছায়াতলে থেকে নানা ব্যবসার পরিকল্পনা আমাদের সাজাতে হবে। তবেই না আমি একজন সার্থক মুসলিম ব্যবসায়ী হতে পারি। গতানুগতিক ব্যবসার শৃঙ্খল থেকে বের হয়ে একটি নতুন মডেল তৈরি করতে হবে।

যারা উলামা আছি, এসব সেক্টরে আমাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিত্য নতুন গবেষণা ও হালাল সার্টিফিকেশনের বডিতে সক্রিয়ভাবে আমাদের যুক্ত হতে হবে। আমরা থাকতে হালালের নামে মানুষের কাছে হারাম বা সন্দেহযুক্ত প্রোডাক্ট পৌঁছে যাবে, এতে আমরা কিন্তু দায় এড়াতে পারব না।

ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কারো সাথে কথা হলেই আমি বলি, আপনাদের প্রতিটি ব্রাঞ্চে কমপক্ষে একজন আলিমের নিয়মিত অফিস করার ব্যবস্থা করতে হবে। নতুবা আপনাদের ১০০% ‘ইসলামিক’ হওয়াটা কখনো বাস্তবে পরিণত হবে না। ব্রাঞ্চের প্রতিটা বিনিয়োগ এই আলিমের সাইন দিয়ে পাশ হবে। পরে তা ব্যাংকের কেন্দ্রীয় শরীয়াহ কমিটিতে যাবে। নতুবা কয়েকজন আলিমের একটি ছোট কমিটি মাসে দুয়েকটি মিটিং করে কীভাবে হাজারো লেনদেনের ‘ইসলামিক’ হওয়াটা নিশ্চিত করবে?!

ঠিক তেমনি প্রতিটা সাধারণ কোম্পানিরও একটি শরীয়াহ কমিটি থাকা উচিৎ। খাবার-পানীয় বা ব্যবহার্য প্রোডাক্ট উৎপাদন বা বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান হলে তাদের প্রোডাক্ট শরীয়াহ সম্মত হলো কিনা, এই কমিটি বিষয়টি দেখবে। বা হালাল সার্টিফিকেশন যেই নমুনার রিপোর্টের ভিত্তিতে নেয়া হয়েছে, কোম্পানি ঠিক সেভাবেই প্রোডাক্ট উৎপাদন করছে কিনা, এই কমিটি তা নিশ্চিত করবে। অনুরূপভাবে তাদের লেনদেনগুলো হালাল কিনা, সুদভিত্তিক লোন ও হারাম বিনিয়োগ থেকে মুক্ত থাকা – ইত্যাদিও এই কমিটি নিশ্চিত করবে।

ব্যবসায়ী ভাইগণ! এতে আপনার ও আপনার কোম্পানির উভয়েরই লাভ হবে। আপনার কোম্পানির হালাল অবস্থা সম্পর্কে মানুষ কাছে যখন নিশ্চিত হবে, আপনার প্রোডাক্টের চাহিদা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে। পাশাপাশি আপনিও ইনশা’আল্লাহ আপনার ব্যবসার প্রতিটা কাজের মাধ্যমে সওয়াব লাভ করবেন, অন্তর্ভুক্ত হবেন সেসব সৎ ব্যবসায়ীদের দলে, যাদের ব্যাপারে প্রিয় রাসূল স. নবী-সিদ্দীকদের সাথে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন।

আল্লাহ আমাদের ইসলামের ছায়াতলে এক হয়ে কাজ করার তাওফীক দিন। আমীন।