অ্যাঙ্গোলায় ইসলাম ব্যান – সত্য না বিভ্রান্তি?

“অ্যাঙ্গোলা বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ইসলাম ব্যান করেছে, মসজিদগুলো অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে” – গত কয়েক ঘণ্টায় ফ্রেন্ড লিস্টের হট নিউজ এটা। খবরটা যে কোনো মুসলিমের জন্য অত্যন্ত মর্মন্তুদ, অসহনীয়। বরং, যে কোনো শান্তিপ্রিয় মানুষকেই তা ব্যথিত করবে। অবশ্যম্ভাবী-রূপেই নিউজটি প্রচুর শেয়ার হচ্ছে, কমেন্ট হচ্ছে।

তবে এরকম নিউজ হুট করে শেয়ার দেয়ার আগে যাচাই করাটা আবশ্যক মনে হলো। গুগলে খোঁজ করতেই প্রথমে জিহাদ ওয়াচের লিংক আসল। রবার্ট স্পেন্সারের জিহাদ ওয়াচ। মুসলিমদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক মিথ্যে তথ্য বানানোর স্পেশালিষ্ট যিনি। এটা একটা চক্রের অংশ। উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা প্রচারে বছরে বিলিয়ন ডলারের অনুদান গ্রহণে যাদের তথ্য ফাঁস করে রিপোর্ট করেছিল আমেরকিান প্রোগ্রেস। (দেখুন: http://www.americanprogress.org/issues/religion/report/2011/08/26/10165/fear-inc/)

নিউজটি গতকালের, ২৪শে নভেম্বর ‘১৩। জিহাদ ওয়াচ নিউজের সাথে একটি মিনার ধসানোর ছবি দিয়েছে। (দেখুন: http://www.jihadwatch.org/2013/11/angola-reportedly-bans-islam-destroys-mosques.html) গুগলে আবার খোঁজ করলাম। ছবিটার ব্যাপারে পুরনো একটি লিংক বের হলো। গত বছরের জানুয়ারিতে অন্য এক সাইটে ইসরাইলের প্রসঙ্গে নিউজে প্রকাশিত হয়। (দেখুন: http://hadafna.net/full.php?ID=3414&title=%D8%AF%D8%A7%D8%A6%D8%B1%D8%A9+%D8%A3%D8%B1%D8%A7%D8%B6%D9%8A+%D8%A5%D8%B3%D8%B1%D8%A7%D8%A6%D9%8A%D9%84+%D8%AA%D9%87%D8%AF%D8%AF%3A+%D8%B3%D9%8A%D8%AA%D9%85+%D9%82%D8%B1%D9%8A%D8%A8%D8%A7+%D8%AD%D8%B1%D8%A7%D8%AB%D8%A9+1000+%D8%AF%D9%88%D9%86%D9%85+%D9%85%D8%B2%D8%B1%D9%88%D8%B9%D8%A9+%D8%AA%D8%B9%D9%88%D8%AF+%D9%84%D8%B9%D8%B1%D8%A8+%D8%A7%D9%84%D9%86%D9%82%D8%A8+%D9%88%D8%AA%D9%83%D8%AB%D9%8A%D9%81+%D9%87%D8%AF%D9%85+%D8%A7%D9%84%D8%A8%D9%8A%D9%88%D8%AA#.UpNkzdJe989)

নিউজটি প্রথম যে পোস্টের মাধ্যমে জানতে পারি, সেটির সোর্স লাস ভেগাস গার্ডিয়ান এক্সপ্রেস। (দেখুন: http://guardianlv.com/2013/11/islam-banned-in-angola/) এই নিউজে ব্যবহৃত ছবি গত বছর মার্চে অন্য এক সাইটে অন্য প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে। (http://www.nairaland.com/900230/lagos-state-govt-demolish-five)

মধ্য আফ্রিকার দেশ অ্যাঙ্গোলায় মোট জনসংখ্যা ২০০৯ এর তথ্যমতে প্রায় দুই কোটি। (দেখুন: http://en.wikipedia.org/wiki/Angola) এর ৯৩.২৮% খ্রিস্টান এবং মুসলিম মাত্র ১.০৯%। তবে ধর্মীয় কারণে বিভাজন (বা সাম্প্রদায়িকতা) সমস্যা নেই বললেই চলে। (দেখুন: http://www.thearda.com/internationalData/countries/Country_7_1.asp)

ফ্রেন্ড-লিস্টের দুই জন পরিচিত ভাই অ্যাঙ্গোলাতে থাকেন। তাদের একজনকে নিউজটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে যতদ্রুত সম্ভব প্রকৃত ঘটনা জানাতে অনুরোধ করলাম। তিনি কিছুক্ষণ সময় নিয়ে লিখেন:

“আমি দেখেছি নিউজগুলো। হোয়াক্স কি-না এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু এতটুকু বলতে পারি এখন পর্যন্ত এখানকার লোকাল মেইনস্ট্রিম মিডিয়াগুলো কিছু প্রকাশ করে নি এ ব্যাপারে। আমার স্থানীয় পরিচিত কেউ কিছুই জানাতে পারলো না। বরং এরা বেশ অবাক হলো যে আমার কাছ থেকে তারা শুনতে পাচ্ছে নিজ দেশের এতো বড় একটি সংবাদ ! যে ক’টি নিউজ সোর্স দেখলাম এরা সবাই বিভিন্ন অসমর্থিত সূত্রের কথা বলছে। ভালো হয়েছে আপনি মেসেজ দিয়েছেন। একটু আগে একটি স্ট্যাটাস দেখলাম। এক ভাই জিহাদের ডাক দিচ্ছিলেন। ভাবছিলাম সেখানে কমেন্ট করবো। ভালো হলো এখন আপনি বিস্তারিত দিতে পারবেন। আমি অবশ্য সব কটি ছবির সোর্স রিভার্স করে দেখলাম, ফেক !! কাজেই হোয়াক্স হবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারি না।

অন্যদিকে বলা যায়, এ দেশের বর্তমান পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে নতুন করে। গেল শনিবার সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের উপর নতুন করে নির্যাতন চালিয়েছে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার। আপনি হয়তোবা জানেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ৪৫ বছর ধরে ক্ষমতায়। বিরোধীদের উপর নির্যাতন করেই তিনি টিকে আছেন। আপাতত তাদের আভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছাড়া তেমন কোন সমস্যা নেই। আমার পূর্ণ মনোযোগ রয়েছে ইস্যুটির উপর। আপডেট কিছু হলে জানাবো। ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফিজ।”

ভাইয়ের ম্যাসেজ থেকে বিষয়টাতে রাজনৈতিক গন্ধ পাচ্ছি। ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট এমনিতেই দৌড়ের ওপর আছেন। এ অবস্থায় এমন কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত বিরোধীদেরই সুযোগ করে দেবে। বরং বিরোধীদের দ্বারা এমন নিউজ ছড়ানোর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

মন্তব্য: ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়ে মুসলিম যুবকদেরকে উস্কে দিয়ে পরে সন্ত্রাসবাদের তকমা লাগানো একটি পুরনো গেইম। তাই শুধু এরকম নিউজ নয়, যে কোনো নিউজ প্রকাশ করার আগে ভালোভাবে যাচাই করে নেয়া উচিৎ। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِن جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَن تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَىٰ مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ

মুমিনগণ! যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোন সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশত: তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হও। (সূরা হুজুরাত: ৬)

এই আয়াতে সংবাদ তৈরি ও প্রকাশে ইসলামের মৌলিক নীতি চলে এসেছে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সকল বিষয়ে আরো সতর্ক হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।

বি:দ্র: নিউজটির ওপর আমার ও অ্যাঙ্গোলার সেই ভাইয়ের সার্বক্ষণিক দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকবে। নিউজটি সত্যতার ব্যাপারে নিশ্চিত হলে ইনশা’আল্লাহ অবশ্যই জানাব। জাযাকুমুল্লাহ।

============

আপডেট: আঙ্গোলায় অবস্থিত ভাই সরকার ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি বরাত দিয়ে নিম্নোক্ত বার্তাটি পাঠান:

“There has been contradictory and confusing messages on this sensitive issue. The general perception is that the govt is acting based on two factors – external pressure to curb the flow of Muslim population from the West African countries which has some roots to radical Islam (Mali, Niger and part of Mauritanians) and domestic cultural threat as Islam is making an inroad into socio-cultural lives of Angola. So far, the government is threatening to demolish the mosques that are built without permission. There isn’t a kind of ‘crusade’ declared against Islam per se, but it has a dimension to clamp down the illegal immigrants which are predominantly Muslims.”

“এই স্পর্শকাতর বিষয়ে পরস্পরবিরোধী ও বিভ্রান্তিকর বার্তা দেখা যাচ্ছে। সাধারণ উপলব্ধি হলো, সরকার দুটি বিষয়কে লক্ষ্য করে কাজ করছে। ১. পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো, যেখানে মৌলবাদী ইসলামের কিছু ভিত্তি আছে (মালী, নাইজার এবং মরিতানিয়ার কিছু অংশ), সেখান থেকে আসা মুসলিম জনসংখ্যার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করতে বহির্বিশ্বের চাপ। এবং ২. অভ্যন্তরীণ সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব, যেহেতু ইসলাম অ্যাঙ্গোলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে অবস্থান করে নিচ্ছে।

এখন পর্যন্ত, সরকার সেসব মসজিদ ধ্বংসের হুমকি দিচ্ছে, যেগুলো সরকারের অনুমতি ছাড়া নির্মিত হয়েছে। এখানে ইসলামের বিরুদ্ধে ‘ক্রুসেড’ টাইপের কিছু ঘোষণা করার ব্যাপার ঘটে নি, তবে এতে অবৈধ অভিবাসীদের শক্ত হাতে দমন করার বিষয় রয়েছে, যারা প্রধানত মুসলমান।”

মন্তব্য: নিউজটি তাহলে কীভাবে ছড়েছে তা বুঝা গেল। যা কিছু রটে, তার কিছু হয় বটে। সেই ‘কিছু’র মাত্রা জানা গেল। পোস্টে নজর রাখার জন্য ধন্যবাদ।

=================

সংযুক্তি:

যেসব সোর্স থেকে প্রাথমিকভাবে নিউজটি ছড়িয়েছে, IBtimes.com সেগুলোর অন্যতম। গতকাল সর্বশেষ তারা অ্যাঙ্গোলার কয়েকজন ডিপ্লোম্যাটের বরাত দিয়ে নিউজ করেছে যে, ইসলাম ব্যান করার মতো কিছু ঘটে নি, বা তারা জানেন না, বা এমন কোনো নথি নেই। (দেখুন: http://www.ibtimes.com/angola-denies-it-banned-islam-destroyed-mosques-1484898)

এছাড়া আরেকটি প্রাথমিক সোর্স ছিল africanglobal.net । নাম দেখে অনেকেই আফ্রিকান সাইট মনে করেছেন। এর ডোমেইন রেজিস্ট্রেশন ডাটায় দেখা যায়, রেজিস্ট্রেশন ইনফো প্রাইভেট করে রাখা। (দেখুন: http://who.is/whois/africanglobe.net) কোনো নিউজ পোর্টাল তাদের রেজিস্ট্রেশন ইনফো প্রাইভেট করে রাখে না। এটা সন্দেহ আরো ঘনীভূত করছে। তাছাড়া সাইটটি নামে আফ্রিকান হলেও এর প্রায় ৬০% ভিজিটর আমেরিকান ও প্রায় ১০% ভিজিটর গ্রেট ব্রিটেনের। বাকী সব অন্যান্য দেশের। এতেও সন্দেহ চলে আসে। (http://www.alexa.com/siteinfo/africanglobe.net)

উইকিতে এ বিষয়ক যে তথ্য সংযুক্ত হয়েছে, তার সোর্সও africanglobal.net । তবে আরেকটি সাইট শুরু থেকে তা প্রচার করে আসছে। Onislam.net । জিহাদ ওয়াচ নিউজটি এখান থেকেই নিয়েছে। মিশর-ভিত্তিক এ সাইটটির কন্টেন্টগুলো ইসলামিক। তবে একটি ডেসক্রিপশনে দাবী করা হয় যে Onislam.net হলো formerly Islamonline.net অর্থাৎ ইতোপূর্বে এটি Islamonline.net ছিল। অথচ ইসলাম-অনলাইন অত্যন্ত জনপ্রিয় সাইট এবং এখনো তা বহাল তবিয়তে আছে। এবং সেখানে এখন পর্যন্ত Onislam.net -এ পরিণত হওয়ার কোনো ধারণা পাই নি। যাহোক, তারাও অসমর্থিত সোর্স থেকে নিউজটি করেছেন -এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

পরবর্তীতে ইন্ডিয়াটুডে, বাংলাদেশের কিছু অনলাইন পোর্টাল এবং বিশ্বের বিভিন্ন ওয়েব পোর্টালে খবরটি সার্কুলেট হতে থাকে।

এক ভাই একটি ভিডিও লিংক শেয়ার করেছেন। সেই লিংক থেকে ভয়েস অব আমেরিকা পর্তুগিজের লিংকে গেলাম। সেখানে এই পোস্টে ওপরে উল্লিখিত সরকার-ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির বক্তব্যেরই সমর্থন পাওয়া গেল। নিউজটি অনুবাদ করলে দেখা গেল: “The order indicates that the destruction must be carried out because its buildings were built without any authorization.” (http://www.voaportugues.com/content/angola-prossegue-a-destruicao-de-mesquitas/1760403.html) যা সেই ব্যক্তিও বলেছেন। আর প্রসেসটি অনেক দিনের, নতুন নয় – বুঝা গেল।

মন্তব্য: এই নিউজটি অনেক বেশি স্পর্শকাতর। ‘ইসলাম ব্যান’ -এর অর্থ হলো সরাসরি ইসলামে বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। বাস্তবে তা হয়ে থাকলে অনেক আহকাম আবর্তিত হবে। আর সত্য-অসত্য যা-ই হোক, নিউজটি নিশ্চিতভাবে নতুন করে পুরো বিশ্বে মুসলিম ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ঘৃণা, অত্যাচার ইত্যাদি সৃষ্টি করবে। (যার অনেক কিছুই বিভিন্ন ওয়েবে কমেন্ট সেকশনে দেখা যাচ্ছে।) সামগ্রিকভাবে এরকম অরাজকতা সৃষ্টি করা (তাও একটি অ-নির্ভরযোগ্য নিউজকে অবলম্বন করে) ইসলামের মেজাজ নয়। তাই বিষয়টা নিয়ে এত ঘাঁটাঘাঁটি করতে হচ্ছে। ধন্যবাদ।