হিজরী নববর্ষ (১৪৩১): উৎসব নয়, ত্যাগের আহ্বান

দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়; সময় ছুটে যায় আপন গতিতে। মানুষ জন্ম নেয়, মৃত্যুও হয় তার। মাটিতে মিশে যায় তার দেহাবশেষও। বেঁচে থাকে কেবল তার কর্মফল, তার ইতিহাস; যার মৃত্যু হয় না কখনো।

আজ জিলহজ্জ্ব মাসের ৩০ তারিখ। হিজরী বৎসরের শেষ মাস জিলহজ্জ্ব মাস। আগামী কাল হিজরী নববর্ষ। মহররম মাসের ১ তারিখ। ১৪৩১ হিজরী সন শুরু হচ্ছে কাল থেকে। তার মানে, প্রিয় নবীজীর স. ও তাঁর সহচরবৃন্দ মক্কা থেকে মদীনা হিজরত করে গেছেন ১৪৩০ বছর হয়ে গেছে।

বছর ঘুরে এই দিনটি এসে আমাদেরকে নবীজী স. ও তাঁর সহচরবৃন্দের ত্যাগের কথা বরাবর স্মরণ করিয়ে দেয়। নিজ বাড়ি, নিজ পরিবার, নিজ এলাকা, নিজ শহর ছেড়ে সুদূর মদীনার পথে রওয়ানা হয়ে সে সময় কী অসাধারণ ত্যাগেরই না পরিচয় দিয়েছিলেন তারা!

হিজরতের সংক্ষিপ্ত ঘটনা:

নবীজী স. চল্লিশ বৎসর বয়সে নবুওত প্রাপ্ত হন। এরপর পরবর্তী তের বৎসর মক্কায় তিনি ইসলামের প্রতি মানুষকে ডেকে যান। প্রাথমিক ভাবে নিজ পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবকে ইসলামের পথে আহ্বান করার জন্য নির্দেশিত হন তিনি। সে মতে প্রথম দিকে স্ত্রী খাদিজা, ভাতিজা আলী, বন্ধু আবু বকর রা. এবং পরে আরো অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

ওদিকে মুসলমানদের সংখ্যা যত বাড়তে থাকে, তাদের প্রতি মক্কার কাফির-মুশরিকদের নির্যাতনও বেড়ে যেতে থাকে। নবীজী স. নিজেও অনেকবার নির্যাতিত হন, কিন্তু উম্মতের প্রতি তাঁর প্রবল মমতার কারণে তিনি সবকিছু সয়ে গিয়েছিলেন। তায়েফে সারা শরীর রক্তে রঞ্জিত হওয়ার পর জিব্রাইল আ. যখন তায়েফকে উল্টিয়ে ফেলার অনুমতি চেয়েছিলেন, তখন নবীজী স. তাঁকে বলেছিলেন, ‘ওরা তো অবুঝ। বুঝলে নিশ্চয় তারা এমনটি করত না।”

কিন্তু তাঁর সহচরবৃন্দের প্রতি অমানবিক নির্যাতন তিনি সহ্য করতে পারেন নি। ফলে আল্লাহর অনুমতিতে প্রথমে হাবাশায়, এবং পরে মদীনায় সহচরদেরকে হিজরত করার নির্দেশ দেন।

নবুওতের ১৩তম বৎসর জিলহজ্জ্ব মাসে হজ্জ্বের পর আকাবায় মদীনাবাসীর ২য় শপথ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বহু মদীনাবাসী এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। এবং তারা মদীনায় নবীজী স. ও তাঁর সহচরবৃন্দকে নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। মদীনায় গেলে পূর্ণ সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাসও দেন তারা।

এরপর আল্লাহর ইচ্ছায় নবীজী স. তাঁর সহচরবৃন্দকে মদীনায় হিজরত করার অনুমতি দেন। এভাবেই মদীনায় হিজরতের সূচনা হয়। সাহাবায়ে কিরাম রা. একজন-দুজন করে মদীনায় চলে যেতে থাকেন। এরই ভেতর আরো অনেক নির্যাতনের খবর আসতে থাকে।

উম্মে সালামা রা. এর সন্তান কাফিররা ছিনিয়ে নেয়। তাঁর স্বামী একাকীই হিজরত করেন। পরে অনেক দিন পর সন্তান ফিরে পেলে সন্তানসহ উম্মে সালামা মদীনার পথে রওয়ানা দেন। সুহায়ব রা. এর উপরও কাফিররা অনেক নির্যাতন করেন। পরে তার সমস্ত সম্পদের বিনিময়ে তাকে মক্কা ত্যাগ করার অনুমতি দেন।

এভাবে বহু সাহাবী নিজ ঘর, এলাকা, সম্পদ -সবকিছু ছেড়ে কেবল আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য মক্কা ত্যাগ করেন।

মদীনায় তখন কেবল নবীজী স., আবু বকর ও আলী রা. অবশিষ্ট ছিলেন। কাফিররা যখন সবকিছু টের পেয়ে যায়, তখন নবীজী স. কে মেরে ফেলার ব্যাপারে তারা নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

ওদিকে আল্লাহ তায়ালা নবীজী স. কে সব জানিয়ে দেন। নবীজী স. আবু বকর রা. এর ঘরে চলে যান। একসাথে রওয়ানা হন সাওর গুহার দিকে। এরপর পথিমধ্যে ঘটে কত ঘটনা।

নবীজীকে স. জীবিত বা মৃত ধরে আনার জন্য ১০০টি উট পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। মক্কার ঘোড়সওয়াররা সব বেরিয়ে পড়ে রক্তের নেশায়। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্যরকম। গুহার এত কাছে গিয়েও না পেয়ে ফিরে আসে তারা।

এরপর গুহা থেকে মদীনার পথে রওয়ানা হওয়ার সময় সুরাকা বিন মালেক অনেক কাছে চলে আসে। আবু বকর রা: ভয় পেয়ে যান। কিন্তু নবীজী স. নির্ভয়ে বলেন, “ভয় পেও না, আমাদের সাথে আল্লাহ আছেন।” সুরাকা বিন মালেক কয়েকবার ঘোড়া থেকে পড়ে যায়। বুঝতে আর বাকী থাকে না, যে, আল্লাহই মানুষদুটোকে রক্ষা করছেন।

কাছে এসে সে নবীজীকে স. ধরার পরিবর্তে তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে ফিরে যায়। পরবর্তীকালে হুনায়ন যুদ্ধের পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।

এভাবে শত প্রতিকূলতা কাটিয়ে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ, সোমবার, মদীনার কুবা নামক গ্রামে পৌঁছান। সেখানে ইসলামের সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মিত হয়। এরপর মদীনায় আগমন করেন তিনি। মদীনার শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ সবার মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।

গল্পটা খুব সংক্ষিপ্ত, কিন্তু এর পেছনে ত্যাগ অনেক বেশি। বছর ঘুরে হিজরী সন এসে আমাদের সেই ত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আমাদের কত সৌভাগ্য যে, আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দেশ ত্যাগের মতো এত বড় ত্যাগের নির্দেশ দেন না। তিনি কেবল আমাদেরকে তাঁর নিষেধকৃত বিষয়গুলো ত্যাগ করতে বলেন। পরিবার, সমাজ, মানুষ ও মানবতার জন্য কিছু ত্যাগ করতে বলেন। দেশ ত্যাগের তুলনায় এটা তেমন বড় কিছু না। অথচ এই সামান্য ত্যাগটুকুই আমরা করতে পারি না। আফসোস!

হিজরী নববর্ষে তাই আমাদের নতুন উদ্দমে উদ্দমী হতে হবে। জীবনের সর্বস্তরে ত্যাগ স্বীকারের শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোতে হবে আমাদের।

একটি ভুল সংশোধন:

অনেকে মনে করেন, হিজরী নববর্ষ কোনো আনন্দোৎসবের দিন। যেদিন মিটিং-মিছিল হবে, একে অপরকে গ্রিটিংস পাঠাবে, আনন্দ করবে ইত্যাদি। কিন্তু বিষয়টা আসলে ভুল।

কারণ দুটো:

১। যারা এটাকে আনন্দের দিন বলেন, তাদের অন্যতম প্রধান যে যুক্তিটি থাকে, তা হলো, এ দিনে নবীজী স. মক্কা ছেড়ে শান্তির ভূমি মদীনায় চলে যান। মদীনাবাসী শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ সবাই সেদিন আনন্দ করেন। অতএব আমরাও করব।

কিন্তু বক্তব্যটা একেবারেই ভুল। কেননা, নবীজী স. মহররমের ১ তারিখ হিজরত করেন নি, বরং, তিনি হিজরত শুরু করেন রবিউল আউয়াল মাসের প্রথম দিকে, আর মদীনার ‘কুবা’ নামক গ্রামে পৌঁছান রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে।

তাহলে প্রশ্ন, হিজরী সন মহররম মাস দিয়ে শুরু হয় কেন? আর যদি তা হিজরতের সাথে সম্পৃক্ত না-ই হয়, তাহলে তাকে হিজরী সন কেন বলা হয়?

এর উত্তর: ওমর রা. এর সময় যখন আরবী সন প্রবর্তনের জন্য পরামর্শ গ্রহণ করা হয়, তখন সবাই নবীজীর স. হিজরত থেকে সন গণনা করার পরামর্শ দেন। তো, হিজরতের মূল পরিকল্পনা যেহেতু আকাবার ২য় শপথ থেকে হয়, আর তা জিলহজ্জ্ব মাসে অনুষ্ঠিত হয়, তাই জিলহজ্জ্বের পরবর্তী নতুন চাঁদ তথা মহররম মাস থেকে হিজরী সন গণনা করা শুরু হয়।

সারকথা, মহররমের ১ তারিখ নবীজী স. হিজরত করেন নি। কাজেই তাতে আনন্দ করার কিছু নেই। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)

২। যদি এ দিন নবীজী স. হিজরত করতেন, তবু তাতে আনন্দ করার কোনো কারণ নেই। কেননা, নবী স. তাঁর বাকী জীবনে, সাহাবায়ে কিরাম রা., তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ী তথা পরবর্তীকালে কেউ এ দিনে আনন্দোৎসব করেন নি। আর ধর্মের নামে নতুন কিছু করা নিশ্চিত ভ্রষ্টতা। (আবু দাউদ, তিরমিযী إياكم ومحدثات الأمور فإن كل بدعة ضلالة )

সারকথা: এ দিনে আমরা কোনো আনন্দোৎসব করব না। বরং, নবীজী স. ও তাঁর সহচরবৃন্দের ত্যাগের কথা স্মরণ করে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, ধর্ম ও মানবতার জন্য ত্যাগ স্বীকার করার শিক্ষা গ্রহণ করব। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাওফীক দিন। আমীন।