আলেম উলামার কান্না বিফলে যাওয়ার নয়

আলেম উলামা আবার কাঁদছেন। আল্লাহর দরবারে। তাহাজ্জুদে। একাকী। এ কান্না বিফলে যাওয়ার নয়।

প্রায় বারো বছর কওমী মাদ্রাসায় পড়লাম। শিক্ষকতা করছি আরো প্রায় চার বছর ধরে। আফসোস! বোমা মারা বা বানানো তো দূরের কথা, বোমা কী, কীভাবে হয়, কেন হয় – এসব প্রশ্ন কখনো আসেও নি, উত্তরও কখনো জানার সুযোগ হয় নি।

আদব আর শিষ্টাচারের অতিশয্যে দেখেছি বন্ধু ও ছাত্রদের কণ্ঠস্বর নিম্ন হতে হতে প্রায় না শোনার মত হয়ে যেতে। শিক্ষক ও সাধারণ মানুষের সাথে আচার-ব্যবহারে বিনয়ের অতিশয্যে মাথা নিচু করে থাকতে। দেখেছি বন্ধুদের জন্য আপন পিতা-মাতা-ভাই-বোনের চেয়েও বেশি দরদী হয়ে নিজেকে উৎসর্গ করতে। ক্লাসের পর ক্লাস সমাজের মানুষের আদর্শিক ও নৈতিক উন্নয়নের আলোচনায় ব্যয় করতে। পরোপকারে নিজেকে উৎসর্গ করার গল্প শোনাতে। নাবী-রাসূল, সাহাবী, উলামায়ে কিরামের জীবনী শোনাতে।

বাংলাদেশের আর কোনো প্রতিষ্ঠান এতটা সুশৃঙ্খল আছে কিনা কেউ দাবী করতে পারবে না। সময় মতো ঘুমানো, ঘুম থেকে জাগা, খাওয়া-বিশ্রাম নেয়া, বাকী সময়টুকু ক্লাস-তাকরার (গ্রুপ স্টাডি) ও ব্যক্তিগত পড়াশোনা-গবেষণায় কাটানো। হ্যাঁ, রাতে ঘুমের সময় হওয়ার পর রুমের ভেতর লাইট নেভানো হয়ে গেলে বারান্দায় বাড়তি পড়াশোনার জন্য হয়ত অনেক সময় কাউকে ধমকের শিকার হতে হয়। পড়ার মৃদু আওয়াজে বা আলোয় অন্যের ডিস্টার্ব হয় বলে। সারাদিন পড়ার পরও যেন সে তৃপ্ত হয় না, আরো পড়তে হবে, জানতে হবে আরো অনেক কিছু!

যে সময় অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পর্ণো দেখে পার করে, গার্ল-ফ্রেন্ডের সাথে রাতভর গালগল্পে কাটায়, রেডিওর ভুতের গল্প শুনে অন্য জগতে চলে যায়, কিংবা বন্ধুদের সাথে একটু-আধটু ড্রিংস করে, সে বয়সেও এরা শুধু পড়ে। নয়ত আল্লাহর ইবাদতে কাটায়।

পড়াশোনা শেষে বন্ধু-বান্ধব বা ভাই-বোনদের পক্ষ থেকে নানারকম চাকুরী বা ব্যবসার প্রস্তাবনা আসে। তবু তারা সব বাদ দিয়ে ন্যূনতম বেতনের ইলমী খিদমাতকে বেছে নেয়। নি:স্বার্থভাবে। ইখলাসের সাথে। তাও আবার যা বাকী থেকে যায় কখনো বা বছরের পর বছর।

সমাজের এই সাদা পোশাকের সাদা মনের মানুষগুলোকে যাদের হিংসে হয়, তারাই বারবার তাদের গায়ে কালিমা লেপন করতে চায়।

ইতোপূর্বে জেএমবি ইস্যু ছিল। গড়পড়তা সব মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক জেএমবি। বাসে বসলে পাশের সিটের মানুষটিও উঠে গেছে। ভয়ে। আহা! যে মানুষটি আপনার কল্যাণ নিয়ে দিন-রাত ভাবে, তাকেই আপনি ভয় করছেন! অবশ্য এমনটি রাসূলের স. ক্ষেত্রেও হয়েছে। মানুষের কাছে তাঁকে ভয়ঙ্কর যাদুকর, কিংবা পাগল হিসেবে চিহ্নিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছে। সফল হয় নি কোনো কিছুই।

জেএমবি ইস্যুর সময়ও উলামায়ে কিরাম কেঁদেছেন। আল্লাহর কাছে। শেষ রাতে। আজ আবারও তাদের ওপর বোমাবাজির তকমা!

আচ্ছা! যা নিশ্চিত বলে জানেন, তা কি প্রমাণ ছাড়া খণ্ডিত হয়? কিংবা, বাস্তবতার বাইরে কোনো কিছু কি প্রমাণ ছাড়া বলা যায়?

একটি উদাহরণ দেই। নদীতে পানি আছে। পানি থাকে দেখেই তো নদী। কাজেই, পানি আছে তা বলতে প্রমাণের প্রয়োজন নেই। পানি নেই কেউ দাবী করলে প্রমাণ চাওয়া হবে। ছবি বা অন্য কোনো প্রমাণ।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মারামারি, অস্ত্রের ব্যবহার আমরা নিয়মিত পত্র-পত্রিকায় দেখি। ছবির পাশাপাশি ভিডিও-ও দেয়া হয়। তাদের ক্ষেত্রে অস্ত্রের ব্যবহারটা এখন স্বাভাবিক, বা বাস্তবতা (আরবিতে ظاهر)। কেউ যদি বলে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো মারামারি হয় না, কোনো সন্ত্রাসী নেই, তার কাছে প্রমাণ চাওয়া হবে। কারণ সে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত কোনো সত্যের বিপরীত দাবী করছে।

কওমী মাদ্রাসাগুলোতে আজ পর্যন্ত কোনো বোমা ইত্যাদি পাওয়া যায় নি। কোনো ছাত্র অপর ছাত্রকে হত্যা করে নি। প্রধান শিক্ষককে কখনো তালাবন্ধ করে রাখা হয় নি। শিক্ষকদের কখনো ধর্মঘট হয় নি। কাজেই কওমী মাদ্রাসায় কোনো অরাজকতা নেই, এটাই স্বাভাবিক, বা বাস্তবতা। আছে, এটা অস্বাভাবিক, বাস্তবতার বিপরীত। এটা দাবী করতে প্রমাণ লাগবে।

আশ্চর্য হই, যাদের ব্যাপারে প্রতিদিন পত্রিকায় সন্ত্রাসবাদের শিরোনাম হচ্ছে, তারা নিষ্পাপ, আমাদের কাছে। আর যাদের ব্যাপারে সন্ত্রাসবাদের কোনো প্রমাণ নেই, তারা জঙ্গী! আমরা কি তবে জাতীয়ভাবে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হয়ে গেলাম! বিবেকের কাছে প্রশ্ন রইল।

===

বি:দ্র: গতকালের ঘটনার বিবরণ: http://www.dailyinqilab.com/2013/10/08/137533.php