আমার ডায়েরি : ২২/১০/২০১০ : আমাদের টলারেন্স লেভেল বাড়াতে হবে

ঘটনা : ১ :

বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। দুই বাসের কাউন্টার দুই পাশে। এক কাউন্টার থেকে একজন যাত্রী টিকিট নিয়ে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। বাস আসছে না। অনেকক্ষণ পর বাস আসল। কিন্তু ভেতরে দাঁড়ানোরও জায়গা নেই। যাত্রী টিকিট ফেরৎ দিয়ে পাশের কাউন্টার থেকে অন্য বাসের টিকিট নিতে চাইল। কিন্তু বাধ সাধল প্রথম বাসের কাউন্টার ম্যান। শুরু হলো দুই কাউন্টার ম্যানের ঝগড়া। বাবা-মা তুলে গালাগালি, মেরে ফেলার হুমকি, তথাকথিত ‘বড় ভাইদের’ রেফারেন্স ইত্যাদি।

ঘটনা : ২ :

রাস্তায় সিগনাল পড়েছে। একটা ভ্যান সিগনালের প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে। পাশে এক লোক যাচ্ছিল। ভ্যানের চাকা তার প্যান্টে লেগে যায়। অবস্থাদৃষ্টে ভুলটা সেই পথচারীরই মনে হলো। লোকটা রেগে গেল তেলে বেগুনে। পরনে ছিল শার্ট, টাই। চোখ দুটো যেন বের হয়ে যাবে। ‘আমাকে চিনিশ? আমি কে জানিশ? আমি অমুকের ভাই অমুক.. একটা চড় মেরে সব কয়টা দাঁত…… … .. ”

ঘটনা : ৩ :

বাসের মহিলা সিটে কয়েকজন পুরুষ বসে পড়েছে। পেছনে অনেক সিট খালি ছিল। তারপরও। কয়েকজন ওঠার জন্য বলেছে। উঠে নি। একটু পর কয়েকজন মহিলা উঠলেন। তারা পুরুষদিগকে উঠে যেতে বললেন। পুরুষগণ উঠতে চাইলেন না। শুরু হলো পুরুষ-মহিলা যুদ্ধ ২০১০। “মহিলারা মিছিল মিটিং করে সম অধিকার দাবী করে, অথচ বাসে উঠে নির্দিষ্ট সিটে বসে.. .. ইত্যাদি ইত্যাদি..”

গুটিকয়েক মহিলার মিছিল মিটিংকে দেশের সব মা-বোনের ওপর চাপিয়ে দেয়াটা শুধু অযৌক্তিকই নয়, অবিচারও বটে।

ঘটনা : ৪ :

বাসে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, কেউ বসে। যারা দাঁড়িয়ে আছেন তাদের হাত-পা, ব্যাগ ইত্যাদি বসা ব্যক্তিদের শরীরে একটু লাগলেই হলো। ব্যাস। “অসভ্য কোথাকার.. একটু দেখে দাঁড়াতে পারেন না?” “ভাই, সরি, দেখি নি, দেখলে তো নিশ্চয় এমন হত না” “সরি বললেই হলো.. ইত্যাদি ইত্যাদি… ”

ঘটনা : ৫ :

হাসপাতালে গিয়েছি। ডাক্তার দেখাতে। যেই রোগীকে নিয়ে গেছি, তার অবস্থা ভালো না। হয়ত তাকে এডমিট করতে হতে পারে। তিনি বসতে পারছেন না। এরপরও প্রায় ঘন্টাখানেক তিনি বসে রইলেন। পরে জানা গেল, তার সিরিয়ালের আগে পরের অনেকে ঢুকেছেন সিরিয়াল ছাড়াই। ডাক্তারের পি.এস এর কল্যাণে। যাহোক, ডাক্তারকে রিকোয়েস্ট পাঠানো হলো যে রোগীটা খুব সিরিয়াস। একটু দেখে দিলে ভালো হয়। ডাক্তার রোগীর নাম শুনেই তার সিরিয়াসনেস বুঝতে পারলেন। ভেতরে আসতে বললেন। রোগীকে নিয়ে ভেতরে গেলাম।

শুরু হলো অন্যান্য রোগীদের কথা-যুদ্ধ। “হুজুর বইলা ভেতরে গেল গা.. হেগো সিরিয়াল লাগে না.. ইত্যাদি ইত্যাদি..” অথচ তাদের পাশেই এক ঘন্টা ধরে বসে ছিলাম। সিরিয়াল মতো আসলে অনেক আগেই দেখানো যেত।

ঘটনা : ৬ :

রিকশাওয়ালাকে ভাড়া না বলেই উঠে পড়লেন একজন। গন্তব্যে পৌঁছে তাকে ইচ্ছে মতো ভাড়া দিলেন। রিকশাওয়ালা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করল। ব্যাস, বসিয়ে দিলেন দুই গালে দুই চড়।

এখানে বলে নিই, রিকশাওয়ালাকে ভাড়া না বলে যদি কেউ ওঠে, তাহলে গন্তব্যে পৌঁছানোর পর সে যে ভাড়ায় সন্তুষ্ট হয়, সেটা দিতেই বাধ্য হবেন যাত্রী। ইচ্ছে মতো ভাড়া দেয়া অন্যায়। ইসলামও সেটা সাপোর্ট করে না। অনেকে মনে করেন, এখান থেকে ওখানে তো এই ভাড়াই হবে, বলার কী আছে? বলার অবশ্যই আছে। কারণ এখানে রিকশাওয়ালার শ্রম জড়িত। আর সবার শ্রমের মূল্য কখনোই এক নয়। কাজেই সে যে ভাড়ায় সন্তুষ্ট হবে, যে ভাড়ায় সন্তুষ্টচিত্তে তার সাথে মৌখিক চুক্তি হবে, সে ভাড়াই দিতে বাধ্য থাকবেন যাত্রী। অন্যথায় তাকে সন্তুষ্ট করে ভাড়া দিতে হবে। কেননা ভাড়া চুক্তি ক্রয় বিক্রয় চুক্তির ন্যায়ই। কাজেই এখানে মূল্যের ক্ষেত্রে ভাড়া গ্রহণকারী আর ভাড়া দাতা উভয়ের সন্তুষ্টি জরুরী।

এই যে ঘটনাগুলো বললাম, সবই কিন্তু আমাদের সমাজের মুসলিম ভাইদের। কথায় কথায় রেগে যাওয়া, অধৈর্য্য হয়ে ওঠা, অন্য কাউকে সহ্য করতে না পারা ইত্যাদি গুনাগুণ (!) আমাদেরই। আমি ভিনদেশের কোনো গল্প বলছি না।

অথচ এগুলো কি একজন মুসলিমের গুণ হতে পারে? মুসলিম না হলেও কেবল একজন মানুষের জন্যও কি এগুলো মানানসই? মানুষ তো অপর মানুষকে শ্রদ্ধা করে। তার সাথে বন্ধু সুলভ আচরণ করে। তাকে ভালবাসে। তার সাথে কথাবার্তা, আচার-ব্যবহার সর্বক্ষেত্রে ভাতৃত্বের পরিচয় দেয়।

একটি পশু না হয় হঠাৎ ক্ষেপে আরেক পশুকে খুন করতে পারে। কিন্তু মানুষ কি এত নির্মম হতে পারে? তাহলে সে মানুষ কেন? সে পশু নয় কেন?

আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক কাজী মুতাসিম বিল্লাহ সাহেব (আল্লাহ তাকে দীর্ঘ নেক হায়াত দিন, আমীন) একটি কথা সবসময় বলতেন। তিনি বলতেন, “মানুষের ভেতরে দুই ধরনের স্বভাব বিদ্যমান। ১. পশুত্ব। ২. দেবত্ব। (ফেরেশতাদের গুণ, যদিও শব্দটা হিন্দুয়ানী মনে হয়, তবু বোঝানোর জন্য তিনি এই শব্দটি ব্যবহার করতেন।)।

প্রতিটা মানুষের মাঝেই এই দুই ধরনের স্বভাব বিদ্যমান। পশুত্বকে দমিয়ে যে তার ভেতরের দেবত্বকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছে, সেই প্র্রকৃত মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে।

আর পশুত্বকে দমানোর জন্যই ইসলামের আগমন। ইসলাম বলছে,

১. মুমিনরা তো পরস্পর ভাই-ভাই। অতএব, তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে-যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও। -আল কুরআন : ৩৯:১০

২. এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার ওপর অত্যাচার করতে পারে না, তাকে অত্যাচারিত অবস্থায় ছেড়েও দিতে পারে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজনে এগিয়ে আসবে, আল্লাহও তার প্রয়োজনে এগিয়ে আসবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের কোনো বিপদ দূর করতে সাহায্য করবে, আল্লাহ তাআলাও ক্বিয়ামতের দিন তার একটি বিপদ দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ তাআলাও ক্বিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন রাখবেন। – বুখারী : ২৩১০

৩. (মুত্তাকী হলো) যারা স্বচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুতঃ আল্লাহ সৎকর্মশীলদিগকেই ভালবাসেন। আল কুরআন : ৩:১৩৪

৪. কুস্তিতে হারানোই বীরত্ব নয়। বরং রাগের সময় তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারাই প্রকৃত বীরত্ব। -বুখারী : ৫৭৬৩

৫. (তাদের জন্য আল্লাহর কাছে রয়েছে উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী পুরস্কার) যারা বড় গোনাহ ও অশ্লীল কার্য থেকে বেঁচে থাকে এবং ক্রোধাম্বিত হয়েও ক্ষমা করে। -আল কুরআন : ৪২:৩৭

৬. এক লোক নবীজীকে স. বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন, রাগ করবে না। লোকটি কয়েক বার প্রশ্ন করলে রাসুলুল্লাহ স. একই উত্তর দিলেন। বুখারী : ৫৭৬৫

আসুন আমরা প্রত্যেকটি মানুষকে নিজের আপন ভাই মনে করি। নিজেদের টলারেন্স লেভেলকে বাড়ানো চেষ্টা করি। রাসুল স. অবশ্য সে পদ্ধতিও আমাদের শিখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাগের সময় اعوذ بالله من الشيطان الرجيم পড়তে। তাহলে রাগ কমে যাবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন। আমীন।