আমার ডায়েরি ২৪ ও ২৫/০৬/২০১০ | প্রসঙ্গ : কুমিল্লার কর্মশালা ও জুমার বয়ান

‘আমার ডায়েরি’ আইডিয়াটা শ্রদ্ধাভাজন বড় ভাই শামসুল হক সিদ্দিক (চেয়ারম্যান, শাবাকা সফট লিমিটেড) থেকে ধার করা। তাই শুরুতেই তাঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানিয়ে নিচ্ছি। দোয়া করি, আল্লাহর অশেষ রহমত সদা তাঁর সাথে থাকবে। আর সে সাথে দোয়া করি, আল্লাহ যেন আমাকে নিয়মিত অনলাইন ডায়েরি লেখার তাওফীক দেন। আমীন।

২৪ জুন ২০১০ :

গত ২৪ জুন বৃহস্পতিবার থেকে সেই যে রোবটের মতো চলা শুরু করেছি, এর শেষটা এখনো হয়নি। সেদিন ফজরের নামাজের পরই রওয়ানা হলাম কুমিল্লার উদ্দেশ্যে। কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে একটা ‘ইমাম প্রশিক্ষণ সেমিনার’ এ অংশ নিতে। প্রায় আড়াই ঘন্টায় বাস কুমিল্লার ‘শাসনগাছায়’ পৌঁছাল। রোদের তাপটা পুরোপুরি গায়ে লাগার আগেই আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছিলাম।

স্থানীয় এক হোটেলে সামান্য কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে আমরা চলে আসি সেমিনার হলে। কাছের এক মসজিদের পাশেই আমাদের সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়। আমার ল্যাপটপ ব্যাগ কাধে ঝুলিয়ে সেই যে সকালে বের হয়েছি, ততক্ষণে অনেকটা ক্লান্ত। তারপরও এরকম সেমিনার ও ওয়ার্কশপ প্রথম করব, সে জন্য কিছুটা উত্তেজিত তো ছিলামই।

এর আগে অবশ্য উত্তরার ‘রেডফোর্ড রেস্টুরেন্টে’ এক ইমাম প্রশিক্ষণ সেমিনারে ইসলাম প্রচারে মিডিয়ার ব্যবহার নিয়ে কিছু কথা বলেছিলাম। স্বল্প সময়ের সে বক্তব্য অনেককেই নাড়া দিয়েছে বলে জেনেছি, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু, ঠিক কর্মশালা টাইপের কিছু আগে করা হয়নি।

যা হোক, আগের রাত জেগে তৈরি করা প্রেজেন্টেশনটা প্রস্তুত ছিল ল্যাপটপে। কিন্তু প্রজেক্টর, ল্যাপটপ এসব বসানোর কোনো ব্যবস্থা স্টেজে ছিল না। অনুষ্ঠান চলাকালেই সেসব ঠিক করিয়ে নিতে হয়েছে।

ততক্ষণ পর্যন্ত আমার প্রেজেন্টেশনের শিরোনাম ছিল ‘ইলেক্ট্রনিক দাওয়াহ’। ল্যাপটপ খুলে প্রজেক্টর সেট করতে করতে মনে হলো, প্রেজেন্টেশনটার নাম ই-দাওয়াহ রাখলেই বরং বেশি চমকপ্রদ হবে। সেই সাথে সবার বুঝতেও সুবিধা হবে। যেই ভাবা সেই কাজ।

ই-দাওয়াহ নামেই প্রেজেন্টেশনটি উপস্থাপন করলাম। শুরুতে মেইল, গভর্নেন্স, কমার্স, ভোটিং কীভাবে ই-মেইল, ই-গভর্নেন্স, ই-কমার্স ও ই-ভোটিংয়ে পরিণত হলো, এবং এর ফলে এসব কাজে কতটা গতির সঞ্চার হলো, সেসব বললাম। এরপর দাওয়াহ থেকে ই-দাওয়াহ এ গেলে আমাদের কী কী সুবিধা হবে, কীভাবে আমরা উপকৃত হব, তা তুলে ধরলাম।

প্রেজেন্টেশনটির এক পর্যায়ে ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রয়োজন হলো। পূর্ব থেকে কানেকশন চেক করা হয়নি বলে উপস্থিত মাইক হাতে নিয়েই কানেক্ট করার চেষ্টা করলাম। মোবাইলের ব্লু টুথ দিয়ে জিপি ইন্টারনেট কোনো ভাবেই কানেক্ট হচ্ছিল না। জিপি মডেম সংগ্রহ করে চেষ্টা করলাম। তাতেও কাজ হলো না। শেষে ইন্টারনেট ছাড়াই প্রেজেন্টেশন শেষ করতে হলো। পরে অবশ্য জানলাম, ঐ এলাকায় জিপি ইন্টারনেটের কভারেজ নেই। হায় জিপি! হায় ডিজিটাল বাংলাদেশ!

আমার প্রেজেন্টেশনের পরে শ্রদ্ধেয় শামসুল হক সিদ্দিক ভাই ‘ডিজিটাল মসজিদ’ এর উপর একটি আকর্ষণীয় প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করলেন। বিষয়টি আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে।

২৫ জুন ২০১০ :

এক সপ্তাহ পরপর জুমার নামাজ পড়াই। কাজেই প্রতিটা জুমা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আগের রাতে ১১টার সময় বাড়ি ফেরায় ও অত্যধিক ক্লান্তি থাকায় সকাল ১০টার আগে জুমার নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে বসতেই পারি নি। যাক, ১০টায় যখন বসেছি, তখন মাথায় অনেকগুলো বিষয় ঘুরছে। কোনটা রেখে কোনটা বলব, ঠিক করতে সমস্যা হচ্ছিল। আরবি ক্যালেন্ডারটার দিকে তাকালাম। মনে পড়ে গেল, আরবি রজব মাস চলছে। আর এ মাসকে নিয়ে নানা কুসংস্কার, বাড়াবাড়ি আমাদের সমাজে প্রচলিত। এসব নিয়েই বলতে হবে আজকের জুমায়।

ল্যাপটপ খুলে নোট নেয়া শুরু করলাম। কুরআনের আয়াত, হাদীস, ব্যখ্যাগ্রন্থ ইত্যাদি থেকে কয়েক পৃষ্ঠা নোট নিলাম। ঘড়িতে তখন ১২টা বেজে গেছে। তাড়াতাড়ি প্রিন্ট নিলাম। এখানে বলে রাখা ভালো, আমি সব সময় জুমার আগের বয়ানে ও খুৎবা প্রদানকালে আমার প্রিন্ট করা ছোট্ট নোট সামনে রাখি। এবং যতটা সম্ভব দেখে বলারই চেষ্টা করি। এর কারণ হলো, ছোট থেকে আরব আমিরাতে এবং মক্কা-মদিনায় খতীবদের এমনটা করতে দেখেছি। তারা এমনটা করেন এ জন্য যে, নোট দেখে বলার দুটো উপকারিতা। ১. কুরআনের আয়াত ও হাদীস নির্ভুল ভাবে উল্লেখ করা যায়। ২. অল্প সময়কে কাজে লাগিয়ে খুব সুন্দর সাজানো গোছানো বক্তব্য দেয়া যায়। তাদের ক্ষেত্রে নিশ্চয় এমনটা ভাবা যায় না যে, তারা আরবি কম বুঝেন, তাই দেখে দেখে বক্তব্য দেন।

আমার ব্যাপারটাও তাই। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ যখন বক্তব্য দিতে দাঁড়ায়, তখন তার সহজাত প্রবৃত্তি তাকে বিষয় থেকে অনেক দূরে নিয়ে যায়। কোনো নোট হাতে না থাকলে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে ফিরে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর যেহেতু আমি কুরআনের হাফেয না, হাদীসেরও হাফেয দাবী করতে পারি না, তদুপরি আমি একজন মানুষ, ভুল করাই স্বাভাবিক, আর কুরআন ও হাদীস মর্যাদা যেমন বেশি, তেমনি এ দুটোর ক্ষেত্রে ভুলটাও অনেক বড় ভুল, তাই সতর্কতার জন্য নোট দেখেই কুরআন ও হাদীস থেকে রেফারেন্স টানার চেষ্টা করি।

যাহোক, সেদিন মসজিদে পৌঁছতে খুব দেরি হয়ে যায়। রাস্তায় গাড়ির জ্যাম এর প্রধান কারণ। আমার বয়ান করার কথা ১২.৪৫ থেকে, সেখানে সেদিন পৌঁছি ১২.৪৬ এ। পৌঁছেই মিম্বরে বসে যাই। মোবাইলের ব্লুটুথটা অন করে, মাইক্রোফনটা সামনে নিয়ে রেকর্ডার অন করে বয়ান শুরু করি।

বয়ান চলাকালে মুসল্লীদের চেহারা দেখে মোটেও বুঝতে পারি নি যে, তাদের কাছে আমি একটি নতুন বিষয় তুলে ধরছি। সবাই যেন স্বতস্ফূর্ত হয়েই কথাগুলো শুনছিল। এবং আগ্রহ ভরে মেনে নিচ্ছিল। কিন্তু, নামাজের পর জানতে পারি যে, এ মসজিদে প্রতি বছরই শবে মেরাজ পালিত হয়ে আসছিল। এবং ইতোপূর্বে কোনো খতীব বিষয়টা নিয়ে বলেননি। খুব আশ্চর্য বোধ করলাম। সেই সাথে কিছুটা শঙ্কিতও হলাম যে, নতুন বিষয়কে মুসল্লীরা কতটুকু সত্য বলে মেনে নিবেন। কিন্তু পরে আশ্বস্ত হলাম এটা জেনে যে, যুক্তি ও দলীল ভিত্তিক আলোচনা হওয়ায় কথাগুলো মেনে নিতে কারো কষ্ট হয় নি। আলহামদুলিল্লাহ।