শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন / ক্রয়-বিক্রয় কি ইসলামে বৈধ?

প্রশ্ন: একদিন দেখলাম জুমার নামাযে এক ইমাম সাহেব বয়ান দিচ্ছেন। তিনি বললেন যে মানুষের অঙ্গ প্রতঙ্গ খুব সম্মানীত। তাই অপারেশনের মাধ্যমে যে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়, তা উচিত না। এতে মানুষ আর তার অঙ্গ প্রতঙ্গের অসম্মান করা হয়।

তাহলে কী আমরা অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা বাদ দিয়ে দিবো? যার মাধ্যমে মানুষ নতুন ভাবে বেঁচে থাকতে পারে বা অন্ধ মানুষ দেখার সুযোগ পায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি কী বন্ধ থাকবে?

উত্তর: ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যাসাপেক্ষ।

মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় করাকে ইসলাম অনুৎসাহিত করে দুটো কারণে:

১। মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অনেক সম্মানিত। এগুলো ক্রয়-বিক্রয়ের উর্ধ্বে। এগুলোর কোন মূল্যমান করা সম্ভব নয়।
২। এতে জীবিত মানুষকে মেরে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বের করে ক্রয়-বিক্রয় করার প্রবণতা বাড়বে। ফলে জনজীবনের নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘ্নিত হবে।

১ম পয়েন্টটা তো স্পষ্টই। আর ২য় পয়েন্টটাও ব্যাখ্যা করার কোন প্রয়োজন মনে করছি না। খোদ আমাদের দেশেও এক সময় ছেলে ধরার প্রবণতা খুব বেশি ছিল। প্রায়ই খবর পাওয়া যেত যে, তাদের ধরে বিদেশে পাচার করে দেওয়া হয়েছে। এবং অনেককেই মেরে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বের করে তা বিশ্বের বড় বড় হস্পিটালে এক্সপোর্ট করা হয়েছে।

বেশিদিন আগের কথা নয়। ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যের একটি লোক সম্পর্কে রিপোর্ট পড়লাম। সে লোকটি ঘর থেকে তেমন বের হত না। এলাকায় কেউ তাকে তেমন দেখত না। কিন্তু এলাকা থেকে প্রায়ই বিভিন্ন জনের বাচ্চা হারিয়ে যেত। অবশেষে কিভাবে যেন সে লোকটির সন্ধান পায় গোয়েন্দা বিভাগ। এরপর তার বাসার আশ-পাশের ডোবা-নালা থেকে কংকাল উদ্ধার হয় অনেকগুলো। সে নাকি শিশুদের কিডন্যাপ করে তাদের কিডনী, চোখসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পৃথিবীর নামকরা দেশের নামকরা হস্পিটালগুলোতে এক্সপোর্ট করত। সেই রিপোর্টে পড়েছিলাম, ভারত সরকার আইন করেও এই প্রবণতা ঠেকাতে পারছে না। বিশ্বের বড় বড় হস্পিটালে তিন ভাগের দু ভাগ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই নাকি আসে ভারত থেকে।

ইসলামী আইনে তাই মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এবং এর জন্যে প্রয়োজনে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। মানুষের জীবনের মূল্য ইসলামে সবচেয়ে বেশি।

এবার আসা যাক ডোনেট করে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের বিষয়ে। এ ব্যাপারে এখনো গবেষণা চলছে। আপনার প্রশ্নের পর আল আযহার ইউনিভার্সিটির (মিশর) ফাতওয়া দেখে নিলাম। তারা এটাকে বৈধ বলছেন। তাদের দলীলগুলোও যুক্তিযুক্ত ও বাস্তবসম্মত। তবে তারা বেশ কিছু শর্তারোপ করেছেন।

যেমন মৃত ব্যক্তির ডোনেশন হলে তা তার পূর্বানুমতি লাগবে, কিংবা মৃতের অভিভাবকের অনুমতি লাগবে। জীবিত ব্যক্তির ডোনেশন হলে অঙ্গটা এমন হতে হবে যা হারানোর পর ব্যক্তি মারা না যায় এবং তার স্বাভাবিক চলাফেরায় বিঘ্ন না ঘটে… ইত্যাদি। সবমিলিয়ে ব্যাপারটা অনেক আলোচনাসাপেক্ষ মনে হলো।

এছাড়াও মালেশিয়া ইসলামিক ইউনিভার্সিটিসহ বেশ কিছু দেশের ফাতওয়াও অনুরূপ। তবে ভিন্নমতও আছে। উভয় দিকেই শক্ত দলীল-প্রমাণ।

আমার যা মনে হলো, ঢালাও ভাবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্রয়-বিক্রয়কে বৈধ বলা যাবে না। তবে অতীব প্রয়োজনে, যে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অঙ্গ না পাওয়া গেলে জীবনই চলবে না, এবং এই অঙ্গ প্রতিস্থাপনে রোগী সুস্থ হবে বলে ডাক্তার মনে করেন, সে ক্ষেত্রে বৈধ ডোনেশন পাওয়া গেলে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে। আর তা না হলে, ক্রয় করে প্রতিস্থাপন করাটা বৈধ বলে মনে হচ্ছে না। তবে ইসলামে একটা সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তা হলো, অতীব প্রয়োজনে, মৃত্যু থেকে বাঁচতে, প্রয়োজন পরিমাণ হারামও হালাল হয়ে যায়। তাই এক্ষেত্রেও আল্লাহ মাফ করে দিবেন বলে আশা রাখা যায়।

আর আল্লাহই ভালো জানেন।

আপনার বর্ণনায় বর্ণিত ইমাম সাহেবকে আমি মোটেও দোষারোপ করবো না। কারণ কিছুদিন আগ পর্যন্তও সকল আলিমই এ ব্যাপারে একমত ছিলেন যে, মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করা যাবে না। বর্তমানকালে যুগের প্রয়োজনে, মানুষের প্রয়োজনে নতুন নতুন গবেষণা হচ্ছে। তা সেই ইমাম সাহেব না জানতেও পারেন, তা তার দোষ মনে করছি না।

প্রশ্ন: Necessity is the mother of invention. আমার মনে হয় ইসলামও এই নীতি অনুমোদন করে। যদিও তথ্য প্রমান দিতে পারব না। ইউসুফ ভাই ভালো বলতে পারবেন। যে কোন নতুন সমস্যা বা তার সমাধান আলেম ওলেমাদের ঐক্যমতের ভিত্তিতে ঠিক করার একটা রীতি কিন্তু আছে।

“২। এতে জীবিত মানুষকে মেরে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বের করে ক্রয়-বিক্রয় করার প্রবণতা বাড়বে। ফলে জনজীবনের নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘ্নিত হবে।”
এটা কি কোন হাদিস? কারন আমার মনে হয় এই সমস্যার সমাধান প্রচলিত আইনের মাধ্যমেই করা সম্ভব। মানুষ আর প্রাণী কিন্তু এক না। প্রাণীর অঙ্গ-প্রত্ঙ্গ এর চাহিদা থাকলে তাদের শিকাররের হার বেরে যায়। এই একই যুক্তি কিন্তু মানুষের বেলায় খাটে না।

উত্তর: হা ইসলাম সেই নীতি অবশ্যই অনুমোদন করে। আমার আলোচনার শেষের দিকে অতীব প্রয়োজনে ইসলামের নীতি পরিবর্তনের যে কথাটি বলেছি, তা আপনার কথায় উল্লিখিত নীতিরই সমার্থক।

না, কথাটা কোন হাদীস নয়। এটা আলীমদের প্রদত্ত যুক্তি, যার কিছুটা বাস্তবতা আমরা দেখি, দেখেছি, হয়তো ভবিষ্যতেও দেখতে হবে।

যা হোক, আমি তো বললামই যে, অনেকেই এর বৈধতা দিয়েছেন। যেহেতু কুরআন-হাদীসে এ ব্যাপারে স্পষ্ট নীতি বর্ণনা নেই তাই মতপার্থক্য থাকতেই পারে। তবে গবেষণা চলছে। আশা করি অদূর ভবিষ্যতে আলিমগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ ব্যাপারে একটি ইসলামসম্মত সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশন দিবেন।