উৎসব নয়, প্রার্থনার রাত ‘শবেবরাত’

গত ক’দিন ধরে পত্রিকায় কয়েকটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের অ্যাড দেখতে পাচ্ছি। ‘শবেবরাত প্যাকেজ’ বলে সেমাই, চিনি, দুধ আর কিছু মসলার একটি প্যাকেজ তৈরি করেছে তারা। সেমাই-হালুয়ার রাত ‘শবেবরাতে’ তা রান্না হবে ঘরে ঘরে।

চালের রুটি, বুটের হালুয়া এগুলোও সঙ্গে থাকবে। মধ্যবিত্ত থেকে একটু উচ্চবিত্তের দিকে তাকালে সঙ্গে গাজরের হালুয়া থাকবে। কোরমা-পোলাও তো পুরনো হয়ে গেছে, ফ্রাইড রাইস আর চিকেন-ফ্রাই এখন শবেবরাতের রেসিপি।

মসজিদগুলো সাজবে ব্যয়বহুল আলোকসজ্জায়। বাসাবাড়িতে থাকবে ঈদের আমেজ। আতশবাজি, বোমাবাজি, তারাবাতি, মরিচবাতি, পটকা, গোলাবারুদ -এগুলো তো হাতে হাতে থাকছেই। কোথাওবা কবর-মাজারকে কেন্দ্র করে ‘শবেবরাত মেলা’, আবার কোথাও নামাজ শেষে মিষ্টি, জিলাপির সঙ্গে খিচুড়ি বা শিরনির আয়োজন।

এ তো গেল শবেবরাতে প্রচলিত প্রত্যক্ষ আয়োজনগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ। কিন্তু আসলে শবেবরাত কী, তা কি একবারও ভেবে দেখেছি আমরা?

ফারসি ‘শব’ শব্দের অর্থ রাত। আর বরাত অর্থ ‘মুক্তি’। শবেবরাত অর্থ মুক্তির রাত। যে রাতে আল্লাহতায়ালা জঘন্য থেকে জঘন্যতম পাপীকেও মুক্তি দিয়ে দেন অনায়াসে। একটু অন্যভাবে আমরা বলতে পারি,শবেবরাত হলো রমজানের আগে আল্লাহ প্রদত্ত মুক্তির সুযোগ। যে সুযোগ যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে একজন মুসলমান রমজানের আগেই পাপমুক্ত হয়ে নিজেকে পবিত্র করে নিতে পারেন। এরপর নিষ্পাপ হৃদয়ে রমজান মাসে ইবাদত করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারেন।

আমাদের দেশে দু’রকম লোক আছে। একদল শবেবরাত বলে কোনো কিছু মানতে নারাজ। আরেক দল শবেবরাতকে শবে কদরের স্থানে, বরং তার চেয়েও বেশি মর্যাদায় সমাসীন করতে ব্যস্ত। অথচ দুটিই বাড়াবাড়ি। আর ইসলাম বাড়াবাড়িকে কখনও সমর্থন করে না; সবক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখতে পছন্দ করে ইসলাম।

শবেবরাতের ফজিলত নিয়ে প্রায় ১০ জন সাহাবি নবীজির (সাঃ) হাদিস বর্ণনা করেন। পরবর্তী সময়ে সাহাবি, তাবেঈ ও বড় বড় ইমামের যুগেও শবেবরাতের মূল্যায়ন করতে দেখা যায়। অতএব শবেবরাতকে অস্বীকার করার কোনো পথ নেই।

আলী (রা.) থেকে বর্ণিত,রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন, যখন শাবানের পঞ্চদশ রজনী (শবেবরাত) তোমাদের সম্মুখে আগমন করবে,তখন তোমরা ওই রজনীতে নামাজ পড় এবং পরবর্তী দিন রোজা রেখ। কেননা সেদিনের সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তায়ালা প্রথম আকাশে অবতরণ করেন এবং (বান্দাদের ডেকে) বলতে থাকেন, ‘আছ কি কেউ ক্ষমাপ্রার্থী, যাকে আমি ক্ষমা করে দেব? আছ কি কেউ রিজিক অন্বেষণকারী,যাকে আমি রিজিকের ব্যবস্থা করে দেব? আছ কি কোনো রোগক্লিষ্ট ব্যক্তি,যাকে আমি সুস্থতা দান করব? এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত বলতেই থাকেন। আছ কি কেউ কোনো বস্তুর প্রার্থী? আমি যার সব মনস্কামনা পূর্ণ করে দেব?’ –[ইবনে মাজাহ : ১৩৮৪]

এছাড়া হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন,আয়েশা! তুমি কি জান যে এ রাতে (শবেবরাতে) কী কী ঘটে? তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! তাতে কী কী ঘটে? এরপর রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন,এতে এ বছর মানুষের মধ্যে কারা জন্মগ্রহণ করবে এবং কারা মৃত্যুবরণ করবে তা নির্ধারিত হয়। এতে মানুষের কার্যগুলো গ্রহণ করা হয় এবং তাদের রিজিকগুলো অবতীর্ণ হয়। এরপর আয়েশা (রা.) রাসূলকে (সাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন,হে আল্লাহর রাসূল! কোনো ব্যক্তি কি আল্লাহর রহমত ছাড়া (কেবল নিজ আমল দ্বারা) বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না?

রাসূল (সাঃ) তিনবার বললেন, না। কোনো ব্যক্তিই আল্লাহতায়ালার রহমত ছাড়া বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না। আয়েশা (রাঃ) বলেন,আমি তখন রাসূলকে (সাঃ) জিজ্ঞাসা করলাম, আপনিও না? তিনি স্বীয় মাথার ওপর হাত রেখে বললেন, আমিও না। তবে যদি আল্লাহ আমার ওপর রহম করেন। তাহলে ভিন্ন কথা। একথাও তিনি তিনবার বললেন। [মিশকাত : ১১৫]

এ রকম আরও একাধিক হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, এ রাতে আল্লাহতায়ালা অসংখ্য মানুষকে ক্ষমা করেন। মানুষের রিজিকের ও জীবন-মৃত্যুর ফয়সালা করেন। কাজেই একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করে ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রার্থনা করে এ রাতে খুব কান্নাকাটি করা উচিত।

তবে এজন্য মসজিদ সাজিয়ে লোকজন একত্র হয়ে এক সঙ্গে সারা রাত ইবাদত করার কোনো প্রয়োজন নেই; বরং মসজিদে শুধু ফরজ ও সুন্নত আদায় করে যার যার ঘরে নফল ইবাদত করা যেতে পারে; বরং, উত্তম তো সেটাই।মনে রাখতে হবে, শবেবরাতের আলাদা কোনো আমল নেই। অন্যান্য দিনের মতোই এর ইবাদত। একেক রাকাতে একেক সূরা নির্ধারিত সংখ্যায় পড়ার সমাজে যে প্রচলন রয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আবার কোথাও কোথাও জামাতে নফল নামাজ বা সালাতুত তাসবিহ পড়ার যে রেওয়াজ রয়েছে তারও কোনো ভিত্তি নেই।

দু’রাকাত দু’রাকাত নফল নামাজ, তাসবিহ, জিকির, কোরআন তেলাওয়াত, সালাতুত তাসবিহ, সম্ভব হলে দিনি মাস’আলা-মাসায়েল আলোচনা,ধর্মীয় বইপত্র অধ্যয়ন এবং নবীজির (সাঃ) শানে বেশি বেশি দরুদ শরিফ পড়া -এসবই শবেবরাতের আমল।

সম্ভব হলে পুরুষের জন্য কবরস্থানে গিয়ে কবর জিয়ারত করা,কবরবাসীদের জন্য দোয়া করাও সওয়াবের কাজ। ঘুম এসে যাবে কিংবা চিৎকার-চেঁচামেচি হবে এ ভয়ে মসজিদে সম্মিলিতভাবে নফল নামাজ পড়া অনুত্তম। ঘরে একাকী যতক্ষণ ভালো লাগে ইবাদত করা উচিত। এরপর প্রয়োজনে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেওয়া যেতে পারে। নবীজি সাঃ এমনই করেছেন। মনে রাখতে হবে আল্লাহর কাছে কোয়ান্টিটি নয়, কোয়ালিটি বড়। অতএব হুড়াহুড়ি করে উঠবস করে ১০০ রাকাত পড়ার চেয়ে আগ্রহের সঙ্গে একনিষ্ঠভাবে দীর্ঘ রুকু-সিজদা করে দু’রাকাত পড়া অনেক ভালো। আর সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই নিজের জন্য, নিজের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সব মুসলিম জাতির জন্য বেশি বেশি দোয়া করবে, তাওবা ও ক্ষমাপ্রার্থনা করবে।

বাসার মহিলার এ রাতে যে হালুয়া-রুটি বানাতে ব্যস্ত থাকেন তা একেবারেই অনুচিত। বলা হয় শয়তানই এ রাতে মানুষকে ইবাদত থেকে দূরে রাখার জন্য মানুষকে এসব কাজে ব্যস্ত রাখে। অনুরূপভাবে মসজিদ-মাজারে খিচুড়ি-ফিরনি এসবও বাহুল্য। অনেক জায়গায় তো এসব নিয়ে শোরগোল-মারামারি পর্যন্ত হয়। ইবাদতের রাত কেটে যায় হেলায়-অবহেলায়।

আতশবাজি, তারাবাজি, বোমাবাজি ইত্যাদি যেন না হয় সেজন্য মা-বাবা, এলাকার মুরবি্ব ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিশেষভাবে নজরদারি করতে হবে। এছাড়া ইবাদত করার আড়ালে কোনো অনৈতিক কর্মকাণ্ড হচ্ছে কি-না সেদিকেও সবাইকে সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে। হাদিসে কয়েক ধরনের লোকের কথা এসেছে। যারা এ রাতেও আল্লাহর করুণা ও দয়া থেকে বঞ্চিত। তাদের মধ্যে হিংসুক, মুশরিক, অন্যায়ভাবে হত্যাকারী, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, মদ্যপায়ী, জাদুকর, চাঁদাবাজ, ব্যভিচারী-ব্যভিচারিণী, সুদখোর ও অত্যাচারী সৈনিক অন্তর্ভুক্ত। অতএব, তাদের বেশি করে এ রাতে ক্ষমা চাওয়া উচিত এবং ভবিষ্যতে এসব পাপ আবার না করার দৃঢ়সংকল্প করা উচিত।

অনেকে শবেবরাতের পর দিন অর্থাৎ ১৫ শাবান রোজা রাখেন। এটি কেবল একটি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, তাও দুর্বল। অতএব, তা শবেবরাতের উসিলায় নয়; বরং এমনিতে আরবি মাসের ১৫ তারিখ আইয়্যামে বীয উপলক্ষে রাখা যেতে পারে।

সবশেষে কথা হলো, পাপমুক্ত হয়ে রমজান মাসকে স্বাগত জানানোই এ রাতের তাৎপর্য। অতএব এশা ও ফজরের নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করে সারারাত ইবাদত ও প্রার্থনায় কাটাতে পারলে তা-ই হবে এ রাতের সঠিক মূল্যায়ন। আলোকসজ্জা, হালুয়া-রুটি আর আতশবাজির মেলা এ রাতের পবিত্রতায় আঘাত হানে। কারণ উৎসব নয়, কেবল প্রার্থনার রাত ‘শবেবরাত’।

—————————————————–
৬ই আগষ্ট ‘০৯ সমকালে প্রকাশিত – লিংক